ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Tuesday, October 25, 2022

রিভিউ : বেশ্যা ও বিদুষীর গল্প

।।লুবনা ইয়াসমিন।।


আফরোজা সোমাকে 'বেশ্যা ও বিদুষীর গল্প' প্রবন্ধ সংগ্রহের জন্য শুভেচ্ছা। বইটিতে চারটি পর্বে মোট সাতাশটি প্রবন্ধ আছে। প্রকাশ করেছে হাসান্স। নারী অধিকার আন্দোলনের পথ চলতি বিষয়গুলো অর্থাৎ শ্রেণিগত বৈষম্য, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ গণমাধ্যমের ভাষায় নারীর প্রতি বিদ্যমান অসহনশীলতা ও অসংবেদনশীলতা কখনোই টিপিকাল চর্বিত চর্বণ নয়, বার বার তাতে আলোকপাত করবার আছে।

আফরোজার কিছু প্রবন্ধ পড়ে মনে হবে বইটির ফোকাস নারীমুক্তি বা নারীর অধিকার, কিন্তু সবগুলো প্রবন্ধ পড়লে বোঝা যায় ফোকাস আসলে মুক্ত সমাজ, আর ফোকাস সেখানে নিতে গিয়ে আফরোজা নারীর পাশাপাশি মনোযোগ দিয়েছে পুরুষতন্ত্রের শিকার পুরুষের বঞ্চনার দিকে, পুরুষের বন্দীত্বের দিকে। মজার বিষয়, বইটির প্রকাশক হাসান্স আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে আফরোজা বাদে বাদবাকি আলোচক সব পুরুষ কবি, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ। আলোচক পুরুষেরা তাদের বঞ্চনা, বন্দীত্ব নিয়ে বলবার অনেক খোরাক পেয়েছে বইটিতে। একটি জুম আলোচনাতে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক উনি বাদে আরেকজন পুরুষ আলোচক এবং শাহবাগ আন্দোলন খ্যাত রাজনীতিবিদ লাকি আখতারকে বইটির ওপর আলোকপাত করতে আমন্ত্রণ করেছেন।

বাংলাদেশসহ আরো অনেক অঞ্চলে দেখা যাবে নারীবাদের ফোকাসকে শ্রেণী সংগ্রামের মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় সরিয়ে ফেলা হয়, যাতে সামগ্রিক সমাজের মুক্তির কথা আগে বলা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, সাবেক পূর্ব ইউরোপীয় কম্যুনিস্ট দেশগুলো এবং বর্তমান চিনের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে নারী অধিকারের ক্ষেত্রে, সংখ্যালঘু অধিকারের ক্ষেত্রে এ দেশগুলো মার্কসবাদের পথে খুব একটা সামনে আসতে পারে নি। যে স্বাতন্ত্র্যের জায়গাতে তসলিমা নাসরিনেরা হুমকির মুখোমুখি হয়ে দেশ ছাড়েন, আফরোজাদের লেখা বলে দেয় যে সে হুমকিগুলো পুরো মাত্রাতে বজায় আছে এবং নারী নির্যাতনের সাথে পুরুষের বঞ্চনাকে ভারসাম্যে এনে যে লেখাগুলো আসছে তাদের অনেকগুলোই আসলে এপোলজিস্ট লেখা।

বাংলাদেশে বেরিয়ে আসা অনেক নারী এমন একটি দেশে বসে লেখেন যেখানে সেলিনা হোসেন, নাসরিন জাহান, রাহনুমা খানম, রাশিদা সুলতানাসহ নিজের জায়গাতে দাঁড়ানো অনেক নারীকে পুরুষের মুখপত্র ভূমিকাকে মেনে নিতে হয়, তাদের সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজটির যোয়াল বইতে হয়, যে সমাজ তসলিমাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। তসলিমার নিজের জীবনও অনেক পুরুষের গাঁটছড়ায় বাধা, যা ছিন্ন করে তাকে স্বোপার্জিত মঞ্চ তৈরি করতে হয়েছে।

নারীবাদকে ঘরের ভেতর অদৃশ্য হাতি বানিয়ে দিলে পরিস্থিতি কি রকম হবে, বা হয়? শাহবাগ আন্দোলনের সময় 'ক্যামেরার মেয়েটি' নামে গল্প প্রকাশিত হলো প্রথম আলোতে, নভেরাকে নিয়ে উপন্যাসের লেখক হাসনাত আবদুল হাই গল্পটির লেখক। যারা তখন দিনের পর দিন শাহবাগ আন্দোলন দেশ, বিদেশ থেকে অনুসরণ করছে তাদের বুঝতে বাকি থাকে নি গল্পটিতে চরিত্র করা হয়েছে লাকি আখতারকে। বিভিন্ন প্যারায় 'ক্যামেরার মেয়েটিকে' বলা হলো ময়লা জিনস, শার্ট পরা ইত্যাদি, পাশ কাটিয়ে যাওয়া হলো মেয়েটি কেনো শাহবাগে সে বিষয়টি। সাবেক আমলা, নাগরিক, লেখক যে কোনো জায়গা থেকে হাসনাত যে কোনো বিষয়ে যে কোনো পার্প্সপেক্টিভে লিখতে পারেন। উনি অস্বীকার করলেন যে লেখাটিতে লাকিকে চরিত্র করা হয়েছে। প্রবল প্রতিবাদের মুখে প্রথম আলো গল্পটি সরিয়ে নেয়। আমি এই প্রত্যাহার সমর্থন করি না।

এই তো কয়েকদিন আগে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে একজন অধ্যাপক একজন নারী ইন্টার্নকে একটা ভুলের জন্য পা ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করেছে। মেডিকেল অনুশীলনের অপরাপর ক্ষেত্রের অনেক পুরুষ সোশাল নেটওয়ার্কার এটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপকের বিপক্ষে জোরালো ভাষায় লিখেছে। এখন এখানে যদি একজন নারী অধ্যাপিকা ঐ নারী ইন্টার্নিকে এভাবে অপদস্থ করতো, আর বাংলাদেশের অধুনার চল অনুযায়ী অধ্যাপিকা না বলে আমরা অধ্যাপক বলতাম, তাহলে নাম ছাড়া আমরা বুঝতে পারতাম না সংশ্লিষ্ট শিক্ষক একজন নারী। যে ঘটনাটা উল্লেখ করছি, সেখানে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক একজন পুরুষ। আমরা অনেকে বলছি যে গায়িকা, নায়িকা, অধ্যাপিকা, লেখিকা বাদ দিয়ে উভলিঙ্গ শব্দ ব্যাবহার করতে। এতে যে শুধু শব্দ ভাণ্ডার কমবে তাই নয়, নারীবাদের ফোকাসও সরে যাবে।

অনেকে নিজেদের নারীবাদী বলতে ইতস্তত করছে এবং নারী, পুরুষদের লেখা নারীবাদী গল্প, নাটক, উপন্যাসগুলোকে চিহ্নিত করছে না, রিভিউ করছে না। এতে মার্কসবাদের প্রত্যাখ্যাত তাত্ত্বিকেরা নারীবাদকে ঘোলা করবার অবকাশ পাচ্ছে। অনেক সময় এ তাত্ত্বিকেরা মৌলবাদী আন্দোলনকারীদেরও শ্রেণী সংগ্রামী আখ্যা দিচ্ছে। জেন্ডার ফোকাস ছড়িয়ে ফেললেও তত্ব ছাড়ানোর প্রবণতাগুলো আফরোজার আছে। কিন্তু লিঙ্গ সংশ্লিষ্টতা বা সেক্সুয়ালিটি, সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট হতে পারেন নি, সে বিমূর্ত ভারসাম্যের কারণেই হয়তো লেখার অনেকটুকু ছেড়ে দিয়েছেন পুরুষ কিভাবে পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে পড়ছে সে দিকে দৃষ্টিপাত করতে।

আফরোজা সোমার বইটিতে আলোচক পুরুষেরা তাদের প্রতি অনেক সমব্যথী বিষয় পাবেন, বিভিন্ন আলোচনায় তা তারা বলেছেন। এই পুতু পুতু মিডিওকার পুং-পেট্রনাইজেশান ওনার দরকার আছে কি? নারীমুক্তির কথা আনলে পুরুষের মুক্তির কথা কেনো পাড়তে হবে? পুরুষ আর নারী দুজনেই স্তন্যপায়ী গোত্রের বলে? তাহলে কি হুমকির সম্মুখীন অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের নিয়েও বলতে হবে এভাবে যে সমাজ পুরোপুরি পরিবেশ বান্ধব হলে তবেই নারীমুক্তি তথা সাম্যতার ক্ষেত্রে নারী অধিকার বহাল হবে? নারীর অধিকার, বঞ্চনা, নিগ্রহ, উত্তরণের কথা অনেক পুরুষ লেখক বলেছেন, তা মানি এবং তা উল্লেখের দরকার।

ক্যানভাস ছড়িয়ে ফেললে একটা বিষয় ঝুলে যায়, ইতস্তত এবং ঝুলন্ত অবস্থান থেকে নারীবাদের মুক্তি দরকার। 'বেশ্যা ও বিদুষীর গল্প' লিখতে গিয়ে আফরোজা সোমাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। নিজেদের সাথে বোঝাপড়ার পথে আমরা কোথায় দড়িয়ে, কোথায় স্থবির, এ বইটি নিসন্দেহে আবার তা মনে পড়িয়ে দেবে।

লুবনা ইয়াসমিন
২৪/১০/২২
লন্ডন

আফরোজা সোমা : কবি, প্রাবন্ধিক এবং জেন্ডার ও মিডিয়া বিষয়ক গবেষক।
বেশ্যা ও বিদুষীর গল্প : জেন্ডার ও মিডিয়া বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ।