।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।
শ্লোক বা শ্লোকার মূলে আছে শ্রু বা শোনা কথা, সেখান থেকে ব্যক্তিগত উপলব্ধিজাত পদ বাধা।এখানে, এ বছরে লেখা যে কবিতাগুলো একত্র করেছি, সেগুলো এসেছে আশেপাশের আলোচিত বিষয় য্যামন, ইউক্রেন যুদ্ধ, বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অর্জন, গত গরমে ফ্রান্সে ঐতিহাসিক তাপদাহ, অপরিচয়ের স্পর্শ-মাখা কিন্তু সঙ্গীত জগতে অত্যন্ত প্রভাবশালী আলাউদ্দিন খানের কন্যা অন্নপূর্ণার আখ্যান, রানি এলিজাবেথের জানাজা-দিবসে মা ও কন্যাকে স্মরণ।
কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মহাভারতে এবং সমসাময়িক পুরাণ লেখা হয়েছে আনুষ্টুপ মাত্রায়। তার আগে বেদের শ্লোকগুলো বাধা ত্রিস্টুপ ও গায়ত্রী মাত্রায়। বিভিন্ন অঞ্চলের আসমানি কিতাব, লোকজ পুথিতেও মাথা দোলানো আনুষ্টুপ মাত্রা দেখা যাবে। সৌরশ্লোকে এক জায়গায় জালিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কোরান শরীফের সুরা আল-মাসাদের আশ্রয় নিয়েছি। 'তরঙ্গ' সঙ্কলনে কভার ফটোতে য্যামন উম ধরানো শীতের দুপুর বেলায় বিউটি বোর্ডিংএর খোলা চাতালে মেঝেতে বসে পরিচারিকার সাথে খোশগল্পে মেতেছিলাম, 'সৌরশ্লোক সিরিজিটিও' তেমনি গল্পের ভেতরের গল্পটিকে পরতে পরতে মেলে ধরবার খেলা।
হাজার হাজার বছরের মন্ত্র শোনা অভ্যাস্থতার পাশে লিখিত পাঠের জায়গাটা আমাদের সবার জন্য এখনো নতুন। এমন কি বেশির ভাগ ভারতীয় কথিত আবৃতি শিল্পী, গীতিকার শ্লোকের সনাতন মাত্রা থেকে বেরোতে না পেরে, ব্যর্থতা ঢাকছে কথিত আবৃতিযোগ্য কবিতার ছদ্মবেশে। বেদ থেকে পুরাণের কথনভঙ্গি বদলে নেয়াতে বোঝা যায় যে আদিগুরুগনও পরিবেশনার নবায়ন চেয়েছিলেন। তবে আমাদের সময় বাংলা ভাষাতে যেরকম একের পর এক জন্রে শুকিয়ে, নাট্য সাহিত্য ঝরে যাচ্ছে, কবিতা গড়াচ্ছে বার্ধক্যজনিত অলস ছড়ার ছন্দে বা ছন্দের অপব্যাখ্যাজাত গদ্যছন্দে সেভাবে নয়। বেদমন্ত্রের ত্রিষ্টুপ অর্থাৎ ৪৪ অক্ষর বিশিষ্ট শ্লোক থেকে পুরাণের অনুষ্টুপ ছন্দে ৩২ অক্ষর বিশিষ্ট শ্লোকে পৌছাতে আদিগুরুরা যেরকম সময়ের ভেলাতে চড়ে সময় পেরিয়েছিল, সেরকম শব্দ ও সংলাপের কয়েক হাজার বছরের বিচিত্র গলি, উপগলি, চোরাগলি পেরিয়ে আমি পৌঁছেছি আমার নিজস্ব ভঙ্গি 'ভাঙ্গা লিরিক, ভাঙ্গা বয়ানে'
''মাপা শটে ছোটো আপাগন জোড়ায় জোড়ায় কুদরতি ম্যাগপাই,
ক্লোস শট বলগুলো লং শটে তোড়ায় তোড়ায় ফুলেল প্যানোরামা।
মুক্ত মিছিলের খোলামিল পতাকায় আকা স্বাধীনতার লাল জামা।
সবার মনে আনন্দ, তবুও কোথায় য্যানো মৌলবাদী সমালোচনার বন্ধ।''
অভ্যস্ত কোনটি ছেড়ে আপনি একটু এগোবেন, আমিও একটু এগোবো। আধাআধি পথে আমাদের দেখা হবে 'সৌরশ্লোক সিরিজে'!
চয়ন খায়রুল হাবিব
১৪/১১/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
যখন আলো নাই অন্ধকারও নাই
দিন নাই রাত্রিও নাই
সৎ নাই অসৎও নাই
যুদ্ধ নাই শান্তিও নাই
ছিলো শুধু তুমুল তরুণ এক সদাশিব বিগ ব্যাং
বেদের বহু আগে মহারাষ্ট্রে নাম নিয়েছিলে খান্ডোবা
মহেঞ্জোদারোতে পশুপতি আদিশিব
পার্বতীর সাথে দেখা হয়েছিল ঢাকার আজিমপুর মোড়ে
ধীর পায়ে গড়ায়েছিলে বল্লালের ঢাকেশ্বরী মন্দিরে
তার পর এলো দেশভাগ
চলে গেলে কোলকাতার কুমারটুলি অঞ্চলে
দুর্গাচারণ স্ট্রিটের শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দিরে
বিগ ব্যাং বিস্ফোরণে বিপুল বিশাল তীব্র বির্যস্খালনে
নাভিতে পর্বত বাজায়ে পেলে মহাগৌরি পেলে মহাকালী
ললিতা সহস্র নামে হলে নাবোকফের লোলিটা
মার্ক এন্টনির ক্লিও রিচার্ড বার্টনের লিজ টেলার
ফরহাদের শিরি আরব্য রজনীর শেহেরাজাদে
নাবোকফ চয়ন রুপা অপরূপা কাঁধ ধরাধরি
মননের গহিন আঠালো অর্ধনারীশ্বর মজমায়
অপদার্থ তাণ্ডবে পদার্থের গবেষণাগারে
পার্বতীর মা মেনকা যতক্ষণ না বলে : উ মা
অর্থাৎ আর না!
আমরা ততক্ষণ প্রহর চুরি করে একে অন্যর হাত ধরে
একে অন্যকে মনে পড়ায়ে দেই
আজ পহেলা মার্চ আজ শিব রাত্রি আজ ইউক্রেন
পেনকিলারে দুস্বপ্নভাঙ্গা আধোঘুমে পার্বতীরা বলে :
এক্ষুনি নেংটার নাচনে আমাদের শিবলিঙ্গ গ্রাফিক্স পাঠাও
ক্ষীরের কড়াপাক সন্দেশে আমাদের উদর ভরাও
কিন্তু সদাশিবের সহজ কুন্দন সবাইকে মাতায় না
হৃদয়ের জটিলতায় ওরা
আমাদের মাইন্ডসেটে সন্ত্রাস ছড়ায়
কখনো আশালতা আমাদের ভ্রান্তিবিলাস সমূহ বাড়ায়
আমরা সমস্বরে বলি :
আহা অষ্টমূর্তি আহা কামাক্ষী
আহা নিপার নদীর তীরে কিয়েভের সংহার
আদিনর্তকের অবতারে নাচে ভলোদিমির জেলেনস্কি
আমরা আমাদের বাইরে এসে
নাচের স্বাধীন মুদ্রায় আরো বেশী স্বাধীন হতে থাকি
১/০৩/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
সৌরশ্লোক ২ :
তোকে আমরা কুত্তাও বলবো না!
সুরা আল মাসাদ অবলম্বনে।
তাব্বাত ইয়াদা~আবি লাহাবিউ ওয়া তাব্
ধ্বংস হোক তোর নারকিয় হাত, সাথে ধ্বংস হ তুই
কুত্তাও জানে মানুষের বন্ধু হতে
তোকে আমরা কুত্তাও বলবো না
নিপার নামের সেই টেরিয়ার কুকুর
গ্রামোফোন মাইকে শুনেছিল আমাদের প্রাণের নূপুর
ঘেউ ঘেউ ডাকে বয়রা মালিককে জানায়েছিলো
নিপার তীর কিয়েভে বাজে আমাদের আদিবাসের ঢেউ
সেন রাজাদের জুলুম নির্যাতনে
বঙ্গের কবিয়াল নারী কক্কুরিপা পালায়েছিল নেপালে
চর্যার তন্ত্রে গোপন বিদ্রোহ শান্তি ও প্রেমের সঙ্কেত
জালিম শাহিগুলো চেহারাবিহীন ডাকিনী ভুত প্রেত
মা আগনা আনহু মালুহু ওয়ামা কাসাব
আবু লাহাব ও সেন রাজাদের ধন-সম্পদ কোনো কাজে আসে নাই
সাইয়াসলা না রান যা তা লাহাবিউ
অচিরেই তোকে গিলে খাবে তোর তৈরি লেলিহান আগুন
সিরিয়া চেচনিয়া ইউক্রেনে বাজে স্বাধীন বাংলার ধুন
ওয়ামরাআতুহু; হাম্মা-লাতাল হাত্বাব।
যে বহন করে আগ্রাসনের অস্ত্র সে নিপাত যাক
ফী জ্বীদিহা-হ্বাবলুম মিম মাসাদ্
তোর মিসাইল বুলেটে তোর হৃতপিন্ড পুড়ে যাক
না না তোকে আমরা কুত্তাও ডাকবো না
কোনো নামেই তোকে ডাকবো না আমরা
ট্রয় ধ্বংসকারী ইলিয়াড যতই হোক বীরত্বে ভরা
ঘৃণার খাতাগুলো আর খুলবো না আমরা
চয়ন খায়রুল হাবিব
৬/০৩/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
সৌরশ্লোক ৩ :
সূর্য সকলকে সমান আলো, ছায়া দেয়।
সকলের প্রতি যারা সমান তমিজ দেখায় না তারা বেতমিজ।
আদবকেতায় যারা পদবি, ধর্ম, বর্ণ, বয়সের ছোটবড় করে,
তারা সাম্প্রদায়িক, পুরুষতান্ত্রিক, ফ্যাশিস্ট, অপ্রাকৃতিক ও বেআদব।
ক্যাডেট কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার বৈষম্যের ফাঁদে
অবদমিত অবসাদে নারী, শিশু, শিক্ষক ও তামাম শিল্পের হ্যানস্থা বাড়ে।
যিশু, মুহাম্মদ, বুদ্ধ, লেনিন, রোকেয়া, সিমোন ব্যুভোয়া
গুরুজনদের শেখানো আচার, আদবকেতা অগ্রাহ্য করেছিল।
লেখক, শিল্পীরা যেখানে আমলা ও ধনিদের স্যার বলে,
পাবলিককে দূরে ঠেলে প্রাইভেসি, সিক্রেসি গুলায়ে ফ্যালে।
সেখানে আর্ট-ডেকো শিল্পের নামে সম্পদাসক্ত বিকলাঙ্গতা চলে।
সূর্য সকলকে সমান আলো, ছায়া দেয়।
সমানাধিকার-সংগ্রামীদের সূর্য-সিংহ ও সূর্য-সিংহী বলে,
সত্যিকারের হলে!
৫/৭/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
সৌরশ্লোক ৪ : তাপদাহ, কমলা এলার্ট
সব গরমই ভাই টাকার গরম!
টাকা পয়সা ধনসম্পদ আমাকে দিয়ে থুয়ে,
আপনারা একটু ঠাণ্ডা হন।
নাইলে পরিবেশের গভীরে মনের দূষণ।
ফ্রান্সে যে পশ্চিম উপকুলে থাকি
সেই মরবিহা উপসাগরাঞ্চলে তাপমাত্রার কমলা এলার্ট।
বাদবাকিতে দাবাগ্নির লাল সঙ্কেত।
ট্রাফিক লাইটে লাল ঠুটি সবুজ কাকাতুয়া রঙ্গের কাবাব।
আজ শনিবার ৩৩ডিগ্রি, পরশু সোমবার হবে ৪০ডিগ্রি।
হেই মহাশূন্য, আলগা করো খোপার বাধন।
হেই ময়ূর, ময়ূরী পেখম-প্রিজমে বদলাবদলি বাসনার কামরূপ।
হেই দোয়েলিয়া-সাদাকালোতে কি চমকালো মরিচবাতির আলো?
তাপ-দাহের ভেতর ছুটে গেলো একটা লম্বা বরফের ট্রেন।
হাত ধরাধরি, দেহ ল্যাপ্টালেপ্টি সবাই তাতে উঠে পড়েন।
১৬/০৭/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
সৌরশ্লোক ৫ : তাপদাহ, রেড এলার্ট
আজ রবিবার ১৭জুলাই, ২০২২, ফ্রান্সে চ্যানেল পারে
মরবিহা সাগরাঞ্চলে তাপদাহে গতকালের কমলা এলার্ট
আজকে লাল সঙ্কেতে গেছে। গতকাল ছিলো ৩৪ডিগ্রি,
আজকে ৩৭ডিগ্রি, আগামীকালের পূর্বাভাষ ৪০ডিগ্রি।
প্রতিদিন ৩ডিগ্রি বাড়তে বাড়তে তুফানে ধেয়ে আসবে বুনো বৃষ্টি।
কোথাও নিম্নচাপে ফুঁসছে সাগর, কোথাও দাবাগ্নিতে বন উজাড়।
ঘরের ভেতরটা সরাই-জলের কায়দায় শীতল করতে,
ব্রিটানির বৈঠকখানায় এমাথা ওমাথা ঝোলালাম জয়পুরি চাদর।
ব্যালকনির ঠিক বাইরে বিপুল হ্যাজেলনাটের পাতাগুলো
হাওয়ামেহেলে রাজপুতানি-লেহেঙ্গা-নকশীতে পিপাসা-কাতর।
ঘরোয়া ক্যাকটাসে পানি দিতে দিতে, হিপি পনি-টেলে, সাফারি শর্টসে
দৃষ্টিপাতের আলিঙ্গনে হাওয়ামেহেল নাচাই আমি হ্যাজেলনাট চিতায়!
এত প্রকান্ড, এত লণ্ডভণ্ড, এত গরমে, এত নরমে!
আঙ্গুর বেজে ওঠে ফোটা ফোটা ঘামে, আহ আহ ঘুঙ্গুর!
১৭/০৭/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
সৌরশ্লোক ৬ : অন্নপূর্ণা তোমাকে সালাম!
'অন্নপূর্ণা* কিভাবে তুমি এতো সুন্দর শেখাও?'
'আমি জানি না, আমি আসলে আনন্দ আর শান্তি বাজাই।
হরিপ্রসাদকে* শিখায়েছি যা কখনো বাঁশিতে বাজানো যায় না।
পেরেশান হরি জানালো, 'মাজি, বানসুরি মে আইসা হো নাহি সাক্তা।'
আদেশ দিলাম, জরুর হোগা।
তার পর হরি সারা জীবন বাজাতে থাকলো,
যা কখনো কেউ বাজায় নাই।'
'মাজি, তুমি কেনো নিঃসঙ্গ থাকো?'
'লোকজনের সাথে দেখা হলে শান্তি কমে যায়।
সুর আমার নিত্য সঙ্গী।'
'দিনের পর দিন আশেপাশে কেউ নাই,
ফ্ল্যাটে একা একা থাকতে ভয় করে না?'
'মাঝে মাঝে অস্বস্তি হতো।
একবার বাবা স্বপ্নে আবির্ভূত!
স্বপ্নেই শেখালেন একটা মন্ত্র।
বাবা ছিলেন কালী ও কৃষ্ণের ভক্ত।
সেই থেকে ঐ মন্ত্র জপি
এবং অন্ত্যমিলে আমি ভয়-মুক্ত!'
'মাজি, লোকে বলে, তুমি খুব বদ মেজাজি!'
'যাহ, ওটা পন্ডিতজির* রটনা।
লোকজনকে আমার থেকে দূরে রাখতে,
উনি বলে বেড়াতেন, আমি খুব মেজাজি,
কেউ দেখা করতে এলে তেড়েফুঁড়ে উঠি।
কিষান মহারাজ এলেন, সাথে স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরী দেবী।
হাত জোড় করে নমস্কার জানালাম।
দেবী কিষানজিকে সুধালো :
'কাহান উসিনে মুঝে তো গালি নেহি দিয়া।
রাভিজিনে আইসা বোলা থা, পার দেখা নেহি।'
সিদ্ধেশ্বরী দেবী ছিলেন সহজ ও খোলামেলা।
'
মাজি, শুভর* সাথে তোমার আর যোগাযোগ ছিলো?'
'সেই যে শুভ বাবার সাথে বেরোলো!
কিছুদিন ঘুরে ঘুরে বাজালো,
আমার কাছে সুরবাহার শিখেছিলো।
বিয়ে করে বাজনা ছেড়ে দিলো।
তার পর কোথায় যে হারালো!'
সঙ্গীত লাগাতে পারে আগুন, আনতে পারে বৃষ্টি।
সবুজকে বানায় কয়লা, কয়লাকে মাছ,
গরুর ওলান ফুলেফেপে ভরা বর্ষার মেঘমল্লার।
অন্নপূর্ণা দেবী কহে, সঙ্গীতে অপার শক্তি বহে।
২১/০৭/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
অন্নপূর্ণা দেবীর সাথে স্বপন কুমার ব্যানার্জির কথোপকথন অবলম্বনে।
Based on Swapan Kumar Bondyopadhyay's Annapurna Devi — An Unheard Melody (published by Roli Books)
সৌরশ্লোক ৭ : মহারাণী-সাইজ বিছানায়!
একটা বনকে ভালো লাগলে, নিজেকে নিজের কাছে হালকা লাগে।
কয়েকটা বনকে ভালো লাগলে, নিজেকে কয়েক গুন হালকা লাগে।
একবনকে বিশেষ ভালো লাগলে, নিজেকে বিশেষ ভাবে হালকা লাগে।
কয়েকবনকে বিশেষ ভালো লাগলে, নিজেকে কয়েক গুন বিশেষ হালকা লাগে।
একবনকে কয়েকবনের চেয়ে কয়েকগুণ বিশেষভাবে ভালো লাগলে,
রুলার, ক্রোনোমিটার, কম্পাসে একটা দিশাহারা হালকা অবস্থা তৈরি হয়।
তখন মাধ্যাকর্ষণের প্রয়োজনে আপেল খেয়ে
ইবলিশকে দায়ী করে বনমানুষের আদিকথা লেখা হয়।
আদিকথার প্রাপ্তবয়স্কতা অনুযায়ী বিছানার পরিধি ছোটবড় হয়।
ভালো লাগা বনমানুষের সঙ্গ পেলে, ছোট বিছানা বড় মনে হয়।
না পেলে, বড় বিছানাও কম সুতার কাপড়ের মত ধোয়া মাত্র শ্রিঙ্ক।
ভালো লাগা আসলে মাত্রাভেদে তিড়িংবিড়িং, ছেড়া ছেড়া মেঘদল!
মেঘদলের সাথে হলিডে করা যায়,
মেঘদলের কথা বোদলেয়ারের কবিতাতে পড়া যায়,
কিন্তু মেঘের সাথে কি সম্পর্ক করা যায়?
মেঘের গায়ে কি হেলান দেয়া যায়?
যায় তো, খুব যায়!
চয়নের কবিতার গায়ে হেলান দিয়ে,
চয়নের চোখের দিকে তাকালে মহারাণী-সাইজ মেঘের বিছানায়,
বিবিধ পাখিদের আজ্ঞায় শুয়ে, বসে জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়!
লঘুতালে নেচে নেচে, মেঘদলে ভেসে ভেসে,
কখনো গুরুভার বা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চাই নাই।
সম্পর্কগুলো কখনো প্রথম থেকে, ডায়নামিজমের এক পর্যায়ে
গুরু ব্যাপারটা চায়, হালকাটাকে আর চায় না।
মেঘখন্ডগুলো দূরে সরাতে সরাতে, খরায় আটকে,
মাতৃত্ব, পিতৃত্বের সম্বোধনে সম্পর্কগুলো ছদ্ম-বর্ষার খোজ পায়।
যে বর্ষাতে আষাঢ়, শ্রাবণ, সচিবালয়, ধর্মশালা আছে,
এমন কি সম্পদের তিন প্রজন্ম বৃষ্টিপাতও, কিন্তু মেঘমল্লার নাই।
কবিতা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সেই কৈশোর থেকে,
কিন্তু গুরুভার মনে হয় নাই।নির্ভার, নির্বাণ সহজের চেয়ে সহজ!
পিকাসোর কাছে যেরকম সাগর সেচা নীলে মুক্তার দানা,
যাকে নির্বাসনে পাঠায় মাতৃত্বকে গারদে পোরা ফ্রাঙ্কোর জেলখানা।
পান খেতে খেতে, ছাত্র ইউনিয়নের অনুষ্ঠান শেষে
কবি ও ছাত্রনেতা পানক্ষেতের জমি মাপতে মাপতে
চলে গেছে মহেশখালীর বাকে, সাম্পান ভরা পানের সওদায়
দরিয়াপার প্রশাসনকে যুগিয়েছে শেয়ার বাজারের পরিকল্পনা।
লম্বা, খাটো, বালার্ক, কোণার্ক, কিরণ, রশ্মি, স্ফটিক, আকন্দ গাছ,
সম্পর্ক, সাথী এবং অর্কগুলো ভেসে বেড়ায় নুহ-নবীর মহানৌকায়।
এই যে ভাইরাল এটাওটা, কারো কিছুতে হাজার হাজার সাড়া,
সেগুলো কি গুরুত্বপূর্ণ?সেগুলোর সাথে লোকের সম্পর্ক হয়?
শিশুর দোলনায় দুলায়ে যাপনের উল্লাসকে জীবনের ঘানিতে গড়ায়ে,
সম্পর্ক কি ভারবাহী জন্তু? 'টাইটানিক' সিনেমায়,
'আমি দুনিয়ার রাজা' চিল্লায়ে , রাজা না হয়েও মহারাজা তলিয়ে যাচ্ছে
মহারাণী-সাইজ মহাসাগরের বিছানায়!
অন্যদের দেখাদেখি গুরুত্বপূর্ণ হতে,
হাত উঁচায়ে বসে আছি, দয়াল বাবা, বিবিরা দেখে না।
দেখলেও বলে, আরে এতো হালকা পলকা,
কিভাবে তাইলে এটা আসল মেহগনি কাঠের বিছানা?
তিন সত্যি, আল্লার কিরা, বিদ্যা ছুয়ে বলছি,
এটা সত্যিকারের মেহগনি বিছানা এবং পুরো একটা মেহগনি বন!
অথচ লঘু, অথচ চপল শেহেরাজাদের গল্পে, সিন্দাবাদী জাহাজে
লেপ, তোষক, বালিশসহ খলবলিয়ে, ভেসে ভেসে উড়ে যাচ্ছে!
ঠিক যেরকম ভাবে ওড়বার, পোড়বার কথা ছিলো!
২৭/০৭/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
সৌরশ্লোক ৮ :
ভাতৃস্মরণে লেগো বানালাম সারা রাত!
সিরামিক ছুরিতে আনাজপাতি কাটবার সময়
মনোযোগ দিয়ে দেখি সবজির আকৃতি, গতি প্রকৃতি
এবং রং, যা আমাকে মাতায়, তাতায় এবং বাচায়।
বাণিজ্যে পড়াশোনা, সম্প্রচার বেচাকেনা
পেছনে ফেলে আমার কবিতা চলে গেছে সৌরলোকে।
বেলজিয়াম সীমান্তবর্তী লিল শহরে মাতিস-জ্যোতি,
লন্ডন থেকে এলিসের কণ্ঠ ভেসে আসে অনলাইনে,
যেরকম প্রাণ বার বার গুনগুনায় ভালো লাগা গানে।
১৯৮৮ সালে একদিন আমার বাবা, মা,বোনেরা
ও আমি জানলাম যে বড় ভাই আপনের কণ্ঠস্বর
আর আমরা কোনদিন শুনতে পাবো না।
তখন সুপারসনিক বৈমানিক আইনুল হাবিবের বয়স ২৮।
২০২২ সালের ৩১শে অগাস্ট
আপনের জন্ম বা মৃত্যু দিবস নয়।
এ-রাতে ঘরের কোনার টেবিলে আব্বা, আম্মা
ও আপনের সাত বছরের ছবিটার দিকে চোখ গেলো।
আস্তে আস্তে ছবিটা ছবিটার চেয়ে বড় হতে লাগলো।
সাদা কালো ছবিতে রংধনু বর্ণালী খেলতে থাকলো।
আব্বা স্যুট, টাই কালো ডাটির চশমা,
আম্মা সাদা শাড়ি পরে এক হাত আপনের কাঁধে।
তিন জনই দাঁড়ানো।আব্বা, আম্মা ফটো তোলার ঋজু গাম্ভীর্য,
চেক ফ্লানেল শার্ট, কালো জ্যাকেট গায়ে আপনের অস্পষ্ট হাসি।
দেশ বদলানো তিন প্রিয়জনের ছবি,
এবং গাছপালা, কেতলি, টেবল-ল্যাম্প নিয়ে আমার যে হবি,
তার ভেতর জীবন জীবন্ত হলো জীবনের চেয়ে বেশি।
বাবা, মাকে ব্রিটিশ-ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি হিসেবে
কতবার শুনতে হয়েছে অমুকটা করতে হয় তমুক ভাবে।
ক্যাডেট কলেজে আপনকেও সেন্সর নিতে হয়েছে স্বভাবে।
সেসব সেন্সর পেরিয়ে কিভাবে য্যানো চৌদ্দগ্রামের জ্যোতি,
আপন ও যমজ চয়ন, কঙ্কণের হৃতপিন্ডে বুনেছিল নন্দনের আরতি।
আপন যে সুপারসনিক মিগ২১ চালাতো,
বৈমানিক ডেরায় ফিরবার আগে,
তার বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মানুষের সংসার।
ইউক্রেন কি শুধু অনলাইনে,
না কি অনলাইনটা একের পর এক যুদ্ধের বিরামচিহ্ন?
আপনের ভালো লাগতো আঁকাআঁকি এবং ভাস্কর্য।
অনেক ওপর দিয়ে ওড়া বোমারু বিমানগুলোর রাডারে
অনেক নিচে শিশুদের স্কুলগুলো বাধা কবরস্থানের তিথিডোরে।
মহাকাশচারী হতে হলে আমাদের গতির দরকার।
রাতভর লেগো জুড়ে বানালাম উটাপো স্টর্ম-ট্রুপার।
স্টার-ট্রেকিও সত্তর দশক থেকে আশি দশকের স্টার ওয়ার,
১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকাই আজিমপুরি পাতাবাহারের ক্লোন
জীবন বদলাচ্ছে ব্রিটানির পত্রসরসি, মেক্সিকোর ক্যাকটাসের সাথে।
খেলাঘরগুলো গরম হতে হতে এগোচ্ছে রোজ হাশরের দিকে।
আপন উড়ে যাচ্ছে অজানা আকাশে শব্দের চেয়ে দ্রুত গতির চমকে।
আলোর ছটার দিকে তাকাতে তাকাতে আমরা আলোর গতি চাই,
আমরা তারাদের দিকে তাকাই, বিজলি চমকে আর ভয় পাই না।
একটা ছবির পাশে আমাদের হাতে বানানো হরেক রকম খেলনা!
১/০৯/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
সৌরশ্লোক ৯ :
তিন নারীর পরাবাস্তবতা!
রানি এলিজাবেথের জানাজা দিবসে মা ও কন্যাকে স্মরণ।
বৃটিশ রাজের চৌদ্দগ্রামে উনিশ শতকে জন্ম নেয়া
আম্মা জ্যোতির মৃত্যু-দিবস আছে, কোনো জন্মদিন নাই।
রাজ্য হারা ব্রিটেনের লন্ডনে বিশ শতকে জন্ম নেয়া
কন্যা এলিসের জন্মদিন আছে।
জ্যোতি ছিলো দ্বিতীয় শ্রেণির প্রজা।
গণতন্ত্র মেশানো নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে
এলিস ব্রিটিশ পাস্পোর্টধারী নাগরিক
এবং সাংবাদিক হলেও শব্দ ও অর্থের দাঙ্গা বাঁধানো
শ্রেণী-যাঁতাকলের জটাজুটে বন্দিনী।
নাট্যকার এলেন বেনেটের ভাষায়
রানি এলিজাবেথ ছিলো 'আনকমন রিডার'।
আম্মা জ্যোতি ও কন্যা এলিস
ভার্জিনিয়া উলফের ভাষায় 'কমন রিডার'।
তিন পরাবাস্তবতায়
তিন নারী কি কল্পনায় এক সুতায় বাধা?
তা কি করে সম্ভব,
আমরা যদি না হই কৃষন চন্দরের যাদু-বাস্তব-গাধা!
রাজ পরিবারের লোকজন এবং ব্রিটিশ পাস্পোর্টধারীগন
যখন য্যামন খুশি
কমনওয়েলথের যে কোনো অংশে যেতে পারে, থাকতে পারে।
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড বাদে অপর কমনওয়েলথের লোকজন
কেবল পয়েন্ট সিস্টেমের ভরসায় অভিবাসী হতে পারে।
এবং এই অভিবাসনে তারা খুশি।কে হবে না?
নিজে বাঁচলে বাবার নাম, তার পর অন্য বাবাদের গায়েবানা।
চৌদ্দগ্রামের কিশোরী ১৩ বছরের জ্যোতিকে
খেলার মাঠ থেকে ডেকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল।
স্বামী হাবিবুল ছিলো ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর বিমান সেনা।
বৃটিশের ঘটানো চল্লিশি মন্বন্তর থেকে জান বাচাতে
তখন দলে দলে লোক নাম লিখায়েছিল ব্রিটিশের পলটনে।
চৌদ্দগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে বোম্বে,
বোম্বে থেকে করাচি, করাচি থেকে চাকলালা বিমানঘাঁটি।
একের পর এক জাহাজে জ্যোতি ছিলো মানুষের বেশে
যেরকম বরবটির বেলায় বিচি আর আমের বেলায় আটি।
ঝঞ্জায় পড়লে লাইফ বোটে উঠবে, যদি হও ভাগ্যবতী।
সময়খন্ড হয়ে যায় টাইটানিক জাহাজ।
জ্যোতির রক্তকণিকায় আকা এলিস, মাতিসের কারুকাজ।
রানির কফিন দেখতে এলিস রাস্তা ঘাটে লাইন দেয় নাই।
শোনা যায় রাজতন্ত্রী সাদা, কালো, এশিয়ানেরা
না কি দল বেধে ব্রেক্সিট-ভোটে
ইয়োরোপের সাথে ব্রিটেনের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়।
যে বিবাহে শেঙ্গেন-শর্ত-মতে ইয়োরোপের সবাই
শিক্ষা, স্বাস্থ্যে, ভ্রমণে সমানাধিকার পায়।
চ্যানেলের ওপারে জ্যোতির ব্রিটিশ বংশকণিকা এলিস,
এপারে ফরাসি বিপ্লবের উত্তরাধিকার মাতিস-জ্যোতি।
ক্লাস ফোর পাশ জ্যোতি ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়াতো
রবীন্দ্রনাথ, জসিমুদ্দিনের লম্বা, লম্বা লুলাবাই শুনায়ে।
আর পছন্দ করতো গরম ভাত ও নরম শেফালি ফুল।
জ্যোতিকে খুশি করতেই কি না জানি না,
হাবিবুল ঢাকার আজিমপুরের এক তলা বাসার বাগান ঘিরে
লাগায়েছিল অনেকগুলো পেয়ারা গাছ আর রক্তজবার ঝাড়।
এলিজাবেথের কবর হবে
বাবা, মা ও স্বামীর পাঁশে উইন্ডসর সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে।
জ্যোতির বাবা মৌলবি কুরবত আহমেদ,
মা ফয়জুননেসা চৌধুরানির কবরের কোনো নিশানা নাই।
জ্যোতি ও হাবিবুলের কবর শ্বশুর সুফি পির জমির শাহর দরগার কোলে।
জীবন্ত কবরগুলো জাতীয়তা বদলায় রাজত্বের নাগরদোলায়।
চ্যানেলের এপারে ঘুম ভেঙ্গে,
উনিশে সেপ্টেম্বার ২০২২ শরতের রঙ্গে
এলিজাবেথের জানাজা দিবসের বিভঙ্গে,
নাস্তা সারলাম রাতে পাকানো সবজি মেশানো মোটা চালের ভাতে।
রইস ফ্যাশনের বরকত বাড়াতে বলতে পারো মিক্সড ফ্রাইড রাইস।
সাথে ছিলো দুধ দেয়া আর্ল গ্রে চা।
রানি ও তার অতিথিদের জন্য তুলে রাখলাম
পোয়া সকোলা, ক্রোয়াসো এবং ব্রিওশ!
ইউটিউবে জানাজার লাইভ খোশআমদেদে
সুয়োরানী, দুয়োরানীদের ঠাকুমা ঝুলিতে
যোগ হলো আরো কিছু ভ্রান্তিবিলাসী শ্লোক!
নটে গাছটার কিন্তু কখনোই মুড়াবাড় কথা ছিলো না।
১৯/০৯/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
সৌরশ্লোক ১০ :
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ উপলক্ষে।
মাপা শটে ছোটো আপাগন জোড়ায় জোড়ায় কুদরতি ম্যাগপাই,
ক্লোস শট বলগুলো লং শটে তোড়ায় তোড়ায় ফুলেল প্যানোরামা।
সবার মনে আনন্দ, তবুও কোথায় য্যানো মৌলবাদী সমালোচনার বন্ধ।
খবর শুনে আল পথে হেটে হেটে আরেকটি মেয়ে স্কুলে এলো।
স্কুল মাঠে সবার সাথে খালি পায়ে ছেড়া ফুটবল লাথালো ।
পিটি টিচার ভাবলো, আরে মেয়েটিতো খ্যালে খুব ভালো।
তার পর তাকে জাতীয় প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠালো।
এখন বুটের ফিতা, চুলের ফিতা সে একসাথে বাধে।
ক্যাম্প ফেরতা মেয়েটির মা মাটির চুলাতে ভাত রাঁধে।
'মা মা, ভাত দিও না আটা রুটি, লাল শাক ভাজি দাও।
ভাতে যাবো মোটায়ে, রুটিতে আসবে গতি প্রকৃতির গায়ে।'
বাবা উঠেছে খেজুর গাছে, গুড় জমাবে কলসে।
নারী-ফুটবল-চ্যাম্পিয়নশিপ-সুর হিল্লোল দীপ্ত বাংলাদেশে!
২০/০৯/২২
ব্রিটানি, ফ্রান্স
Cover Photo : Choyon Khairul Habib talking to a old lady in Beauty Boarding, Dhaka, 2010.
Photography by Nasir Ali Mamun.Photoseum.