ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, October 22, 2022

রিভিউ : জুলেখার জেরা পর্ব : ২০১৬ - ২০২২

।।সারা যাকের।।বাবলী হক।।রাদ আহমদ।।

।।রফি হক।। রতন সরকার।। দিলরুবা পাপিয়া।।

।।মুরাদ শিকদার।। নিরাময়ী চক্রবর্তি।। শামীমা জাহিদ প্রীতি।।


রেডিও স্বাধীন প্রযোজনা : ডৌল র্ব

শিশির রহমান, পারভীন পারু, জুনাইদ ইউসুফ, 

রাবিউল মাহমুদ ইয়াং, সঙ্গীতা চৌধুরী, চয়ন খায়রুল হাবিব

২০১৬ সালে ২৯ ও ৩০শে মার্চ রাজধানী ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে প্রিমিয়ার হবার পর একই শহরে ছাড়া ছাড়া গ্যাপে ২০২২ অবধি চয়ন খায়রুল হাবিব রচিত ও নির্দেশিত  'ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব' অপেরাধর্মি নাটকটির ৭টি শো হয়েছে। বিভিন্ন সময় নাটকটি দেখেছে পাঁচ মিশেলি দর্শক। কেউ বড় করে রিভিউ করেছে, কেউ কিছু ছবি দিয়ে কয়েক লাইন লিখেছে।  সেসব রিভিউতে নাটকটি ছাড়াও, বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের পরিস্থিতি, পার্ফর্মেন্স আর্টসের শিক্ষকদের সাথে মিডিয়া ও মঞ্চের সুবিধাভোগী সম্পর্ক, ঢাকার পরিবহন পরিস্থিতি, দর্শকদের নিজেদের অবস্থান উঠে এসেছে। নাটকটির দর্পণে ঢাকার নাগরিকেরা তাদের শহরটিকে জেরার মুখোমুখি করেছে।


নাটকটির উদ্বোধক নাট্যজন সারা যাকের স্মারকপত্রে লিখেছিলেন, ''পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটির মঞ্চায়ন বড় একটি চ্যালেঞ্জ।'' সুলেখিকা বাবলী হক কোভিডের ২০১৮তে দেখলেও, ৪ বছর পর ২০২২এ কোভিড পরবর্তী শো এর সময় কুশীলবদের স্বাগত জানিয়ে রিভিউ করেছেন। কবি রাদ আহমেদ ২০১৮সালে দেখে বিস্তারিত রিভিয়ু করেছিলেন 'ছাড়পত্র' ওয়েব খাতায় সে সপ্তাহেই, যা এখানে  একাংশ উঠিয়ে লিঙ্ক দেয়া হয়েছে। 

ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব প্রিমিয়ার, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৬

বাম থেকে, জুনাইদ ইউসুফ, সারা যাকের, পারভীন পারু, শিশির রহমান, চয়ন খায়রুল হাবিব


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক দিলরুবা পাপিয়া নাটকটি দেখেছেন তিনবার ২০১৭, ২০১৮ এবং আলোড়িত হয়ে আমাদেরকে প্রতিক্রিয়া পাঠালেন এবার । একই বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র মুরাদ শিকদার দেখেছেন দুবার। 'শিল্পপ্রভা' আর্টস ম্যাগের  সম্পাদক রফী হক যেরকম গেলো সপ্তাহে ২০২২, সেপ্টেম্বারের শেষ দিন দেখবার পরদিনই নাটকটিকে ঘিরে ঢাকার একটি দিনের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, সেরকম একই শোতে প্রথম বছরগুলোতে উপস্থিত  চারুকলার ছাত্রছারিরা এবং ছবছরের ব্যাবধানে,  মেডিকেল ছাত্রছাত্রীরাও তাদের যার যার যায়গা থেকে নাটকটি নিয়ে লিখেছে।

লেখাগুলো পড়ে একটা  ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, একই শহরে, একই প্রেক্ষাগৃহে একেকজনের কাছে একেকটি সংলাপ দাগ কেটেছে, আবার একই দৃশ্য দুজন, তিনজনের কাছে একইভাবে রেখাপাত করেছে। লেখাগুলোতে লক্ষণীয় যে নির্দেশক ও কুশিলবেরা দর্শককে একই সময় অভিনয়, নাটকিয়তা ও কারিগরি দিকগুলোতে মনযোগী করে তুলতে পেরেছে। অপেরাধর্মি এ নাটকটিতে জেরা অংশ উপস্থাপিত হয়েছে নিরেট গদ্যে, আর সূত্রধরের বয়ান গীতল, যাতে জেরাকারি ও তার বন্দীনি দুজনেই অংশ নেয়। নির্দেশকের বিভিন্ন সাক্ষাতকার থেকে বোঝা যায়, গীতল অংশে জূলেখা, ইউসুফের প্রাচীন বয়ানগুলোকে সূত্রবদ্ধ করা হলেও মঞ্চায়নে বার বার পর্বান্তর ঘটানো হয়েছে জেরা ও গানে দর্শককে এলিয়েনেশান বা বিযুক্ত, বা সোজা ভাষায় দম ফেলার অবকাশ দিতে। কাঠামোর দিক থেকে মঞ্চায়নে চেখোভিয়ান ধারা বর্ণনায় ব্রেখটিয়ান এলিয়েনেশান মেশানো হয়েছে।
 
জুলেখা রুপায়নে পারভীন পারু

এই  এলিয়েনেশান যে দর্শককে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে নি, তা বোঝা যায় সামাজিক মাধ্যমে ছাত্রছাত্রিদের ছোট ছোট লেখায় গানের পাশাপাশি দৃশ্যায়নের বর্ণনায়। ছ'বছরে ছাড়া ছাড়া মঞ্চায়নে 'ডৌলের' অর্জন ও বিসর্জন নিয়ে সম্পাদকীয় একেবারে শেষে। ২০১৬ থেকে ২০২২,  নাটকটি ঘিরে দর্শকদের প্রতিক্রিয়াতে যাবার আগে নাটকটির পাঠক ও প্রথম মঞ্চায়নের দর্শক বাংলাদেশ, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের পুরোধা ব্যাক্তিত্ব সারা যাকেরের বক্তব্য উদ্বোধনী স্মারক থেকে এখানে তুলে দেয়া যাক, 
''ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব' নাটকটি আদি একটা প্রশ্ন তুলে ধরে আমাদের সামনে।

যে গল্প শুরু হয়েছিল আদম এবং হাওয়াকে দিয়ে, হাওয়ার প্রেমে ভ্রম হয় আদমের; সে গন্ধম খায় এবং সেখান থেকে মানব জাতির পতনের সূত্রপাত। একইভাবে দ্রৌপদী এবং পঞ্চ পান্ডবদের কথা মহাভারতে গ্রন্থিত। 'হেলেন অফ ট্রয়কেও' মনে করছি এ ক্ষেত্রে, যার কারনেই এত বড় যুদ্ধ হয়েছিল এগাম্যামনের নেতৃত্বে, এই চিত্র লেখাটি আমরা পাই হোমারের 'ইলিয়াডে'।

বর্তমান যুগে ফেমিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর এই অবস্থাকে প্রশ্ন করা যেতেই পারে এবং সেটা প্রাসঙ্গিক। এই নাটকটির রচয়িতা এবং নির্দেশক চয়ন খায়রুল হাবিবকে শুভকামনা জানাই এই নাটকটির সফল মঞ্চায়ন আশা করে। নারী সকল আদি পাপের উৎস, এইটিই কি তাহলে মেনে নিতে হবে আমাদের?

নাটকটি পড়ে আমার মনে হয়েছে এটির মঞ্চায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আশা করি, চ্যালেঞ্জটি  সফলভাবে গ্রহন করতে পারবে চয়ন এবং নাটকের পাত্র পাত্রীগণ।''
সারা যাকের 
নাট্য ব্যাক্তিত্ব
মার্চ/২০১৬
ঢাকা



এবার আমরা চলে যাচ্ছি ছয় বছরে বিভিন্ন সময়ে মঞ্চে সরাসরি এ নাটকটির কুশীলবদের মুখোমুখি যারা হয়েছেন তাদের ধারাভাষ্যে। অভিজ্ঞ ও কোরক দর্শকদের প্রতিক্রিয়া থেকে জানা যাবে, সারা যাকের যাকে বলেছিলেন 'বড় চ্যালেঞ্জ' কিভাবে তাতে উৎরেছিলেন নাটকটির নির্দেশক ও শিল্পীগণ!

জেরা পর্বের মুখোমুখি তিনবার, দিলরুবা পাপিয়া।

ডৌল, শিল্পকলা একাডেমি, ২০১৮
শিল্পীদের সাথে দিলরুবা পাপিয়া, কাওসার হোসেন টগর

এক 

গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ 'পরিসর আর্ট সেন্টারের' আয়োজনে শিল্পকলা একাডেমিতে আবার প্রদর্শিত হলো 'ডৌল: জুলেখার জেরা পর্ব'। 'ডৌল' আমার পছন্দের একটি নাটক। তাই যারা আবার এর প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন তাদেরকে শুভেচ্ছা, শুভকামনা জানাবো চিন্তা করে রাখলাম। আমার ভুলে যাওয়া রোগ আছে। শেষমেশ তাই হলো।
যথারীতি ভুলে গেলাম। 'ডৌল' সম্প্রদায় পরে শুভেচ্ছা জানালেও কিছু মনে করবেন না আশা করি। 


শুভেচ্ছা 'পরিসর আর্ট সেন্টার', অভিনেতা  অভিনেত্রী- পারভিন পারু, জুনাইদ ইউসুফ, শিশির রহমান এবং 'ডৌল'- এর লেখক, নির্দেশক চয়ন খায়রুল হাবিবকে                            

 দুই

'ডৌল: জুলেখার জেরা পর্ব' প্রথম দেখি ২০১৭ সালে। ডৌল অভিনেতা জুনাইদ ভাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার পুরো বিভাগকে দাওয়াত দিয়ে চারুকলা বিভাগে আসলেন। আমরা একই বিল্ডিং-এর উপর নিচ বসি। এখানেও দাওয়াত হলো। আমাকেও কয়েকটি টিকিট দিলেন। হয়তো ওনার কাছে যা বাকি ছিলো, নিঃস্ব হয়ে আমাকে দিয়ে দিলেন। তবে এই নিঃস্বতে কাজ হলো। শিক্ষার্থীদের শুধু আমিই চারুকলার ৬/৭ জন  নিয়ে নাটকটি দেখতে গেলাম। দুই বিভাগের আর কোনো শিক্ষার্থীকে আমরা দেখিনি। এটা একটু আক্ষেপেরই বিষয়। এইসব বিভাগের শিক্ষার্থীরাই যদি সৌজন্য টিকিটেও নাটকটি না দেখে, তাহলে আর কি করা! যাক্, বোধ তো আর কেউ তৈরি করে দেবে না। এটা যার যার ইচ্ছে। অবশ্য বড়দের কিছু দায়িত্ব তো থেকেই যায়।

          তিন

আশির দশকের মাঝামাঝি আমি বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাথে জড়িত হই আবৃত্তি কর্মশালা দিয়ে। নাটকের সাথে জড়িত হই আশির শেষ দিকে। তবে নাটক মঞ্চে গড়ায় নব্বই দশকের শুরুতে। কয়েক বছর আমি নিজেকে তৈরি করি। শুধু বিবর্তন আয়োজিত কর্মশালা নয়- শিল্পকলা একাডেমি, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট, জার্মান কালচারাল সেন্টার, বা যেখানে যখন এই বিষয়ে কর্মশালা হয়েছে কম-বেশি চেষ্টা করেছি সেগুলো করতে। সুতরাং একাডেমিক কুশলীদের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই বলছি আমরাও কম পরিশ্রম করিনি। আমার প্রথম মঞ্চনাটকটির রচয়িতা এবং নির্দেশক ছিলেন নাট্যকার, অভিনেতা, নির্মাতা,  লেখক জনাব খায়রুল বাসার।


চার 

নিজেকে নিয়ে এতো কথা বলার কারণ হচ্ছে- নাটকের ভালো-মন্দ আমরাও একটুখানি বুঝি। আবার এ ও বলি, সবকিছুর সাধারণ ভালো-মন্দ বুঝতে সেই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে পাশ ফেল করে নিতে হবে না। আপনার যতোটুকু জ্ঞান জীবনে চলে খাওয়ার মতো আছে, তা দিয়ে অনেক সময় সার্টিফিকেটধারীদের চেয়েও ভালো কিছু আপনি করতে পারেন। তাই বলে পড়াশোনা বা সার্টিফিকেট গুরুত্বপূর্ণ না, তা কোনোভাবেই মনে করছি না। 

পাঁচ 

ডৌল '১৭ র পর আরও দু'বার দেখেছি। তার মানে এই নয় যে- কাম নাই তো খই ভাজি। নাটকের প্রতি ভালোলাগা, সময়-সুযোগ মিলে যাওয়া এবং শিক্ষার্থীদের দেখানোর তাড়না থেকে আবার গিয়েছি। কারণ প্রথম যে ক'জন শিক্ষার্থী দেখেছে তাদের থেকেই বাকিরা ডৌল- এর বিষয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছে। তারাই আমাকে বলেছে- ম্যাম আবার 'ডৌল' হলে আমাদেরকে যদি দেখার ব্যবস্থা করে দিতেন ভালো হতো। সেই অনুযায়ী জুনাইদ ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি। উনি যথারীতি ব্যবস্থা করেছেন। ভাইকেও ধন্যবাদ। 


ছয় 

পারভিন পারু, জুনাইদ ইউসুফ, শিশির রহমান কাকে ছেড়ে কার কথা বলবো! প্রত্যেকেই অসাধারণ করেছেন। অসাধারণ অভিনয় বললাম না। কারণ তারা অভিনয় ছাড়াও একটি মঞ্চ নাটকের সামগ্রীকতা নিয়ে কাজ করেছেন। সুতরাং এই নাটকের জন্য তারা শুধু অভিনন্দন নয়, মহাঅভিনন্দন আশা করতে পারেন। আমরা যদি কৃপণ না হই তাই দেয়া উচিত।


সাত

দুই বারই ছোটো দল নিয়ে দেখেছি। কিন্তু তৃতীয়বার আমার সহপাঠী চারুকলা অনুষদ, ঢাবি- র ভাষ্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাওসার হাসান টগর(তখন বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলো) এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের একটি বড় গ্রুপ নিয়ে একসাথে দেখেছি। এরা প্রত্যেকেই মুগ্ধ হয়েছে, আনন্দিত হয়েছে, প্রশংসা করেছে। প্রতিবারই তারা তাদের মতো করে রিভিউ লিখেছে, জুলেখা সিরাপ (এখন নামটা একটু পরিবর্তন হয়েছে) গ্রুপে পোস্ট করেছে। ওদের এই উদ্যোগ, আগ্রহ, ভালোবাসা আমারও ভালো লেগেছে। বিশেষ ধন্যবাদ জানাবো মুরাদ শিকদার এবং হাসানকে। ওরা আন্তরিকতা এবং পরিশ্রম দুটোর সমন্বয় ঘটিয়ে সব্বাইকে ভ্যানুতে নিয়ে যাওয়া, বাড়ি পৌঁছে দেয়া এই কঠিন কাজগুলো করেছে। 


বাকিদেরও ধন্যবাদ। তবে নেতাদেরকে তো বেশি ধন্যবাদ দিতে হয়, তাইনা?


আট 

নাটকটি দেখার পর চয়ন খায়রুল হাবিবের নাট্যকার এবং নির্দেশকের খাতায় নাম লেখানোর জন্য এই একটি নাটকই আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। কারণ এতো মামুলি একটি বিষয় নিয়ে এমন হা করে সর্বক্ষণ মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো নির্দেশনা আমি কমই দেখেছি। নাটকটির নির্দেশনা কখনও কখনও কাহিনীকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। তিন জন পারফর্মার দিয়েই পুরো মঞ্চের সবকিছু করানো এবং যা করছে  সবই দর্শকের সামনে ঘটছে- এই বিষয়টি আমার কাছে উপভোগ্য মনে হয়েছে। এখন হয়তো আরও নতুন নতুন কিছু হয়। কিন্তু 'ডৌল' যখন নির্মাণ হয়েছে তখন বাংলাদেশে এমন নাটকের সংখ্যা কতো ছিলো, সেই প্রশ্ন রাখা যায়। কারণ নির্মাণের কয়েক বছর পরে আমরা দেখেছি। একটুখানি চোখের পলক ফেললেও মনে হয়েছে, কিছু মিস করে গেলাম না তো? ডৌল সম্পর্কে আমার বিবেচনা এমনই।

নয় 

আশির দশকের শেষ দিকে যখন আমি মঞ্চে কাজ করতে শুরু করেছি, তখন থেকেই দেখেছি নাটকের দলগুলোতে পারফরমারের কতো অভাব। অভাব এর আগেও ছিলো, পরেও ছিলো। শুধুমাত্র তারকা দলগুলো ছাড়া সবার একই অবস্থা। সবাই খুঁজতো কম চরিত্রের ভালো একটি নাটক। সেদিক থেকে চয়নের 'ডৌল'  একেবারেই পারফেক্ট। কে জানে অন্যরা সময় মতো জানলে হয়তো কাড়াকাড়ি লেগে যেতো।  অথচ- দেশ ছেড়ে এতোটা দিন বিদেশ- বিভুঁই করেও একজন মানুষ, এতো গরমে, জ্যামে, নিশ্চয়ই নাওয়া-খাওয়ার কষ্টও করে, অনেক দিন দেশে কাটিয়ে নাটকটি তৈরি করেছে সেই নাটকটি দেখে, দেশ প্রেমিক লোকটিকে এইটুকু সৌজন্যতাও অনেকে দেখাই না। খুব ভালো করে জানি খায়রুল হাবিবের নির্দেশনা না হলে এটি ফিশ স্টেকের জায়গায় পোড়া মাছ ভাজা হতো।


দশ 

মঞ্চনাটক আমাকে খুব টানে। শুধু নাটক নয়, আর্ট-কালচারের সবই টানে। কতো বন্ধুরা ডাকে, দাওয়াত দেয়। কিন্তু ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম দিন দিনই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কোথাও যাবো ভাবলেই জ্বর আসে। উপায় থাকলে প্রতিটি অনুষ্ঠানেই যেতাম। সব ইচ্ছেকে এমন গলা চিপে বিনাশ করতে খারাপ লাগে।



ডৌল: জুলেখার জেরা পর্বের চরিত্র রূপায়ণকারী পারভিন পারু, জুনাইদ ইউসুফ, শিশির রহমান সকলকে প্রাণের ভালোবাসা জানাই। শুভকামনা।


দিলরুবা পাপিয়া

          শিল্পী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসক 

০৮/১০/২০২২ , ঢাকা

ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব মহড়া, ২০১৬

 ডৌল দর্পণে ঢাকা, রাদ আহমেদ

ঢাকা 

জানুয়ারি ২৫ এর বিকেলে এসে নামি শিল্পকলা একাডেমির সামনে। সিএনজি থেকে নামতেই একেবারে `স্ট্যান্ড-স্টিল`। বামে ট্রাফিক পুলিশ, ডানে রিকশা, ফাঁক দিয়ে বেরোতে গেলেই মোটরসাইকেল- ওদিকে সামনে গাড়ি- ফাঁকা স্থানগুলো পথচারীতে পূর্ণ। কোথাও যাবার জায়গা নাই। সেগুনবাগিচা আমাদের ছোটকালে অনেক স্মৃতিময় গাছে ঘেরা কাব্যিক আর মননশীল একটা স্থান ছিল। সেই আশায় গুড়েবালি। এটা মেনে নিয়ে কোনোমতে ফুটপাথে এসে উঠি।
ডৌল 
জেরাকারী নাটকের মধ্যেই স্টেজের পিছনে গিয়ে টেবিলে ঝুঁকে লাইটিং নিয়ন্ত্রণ করছে, আবার সূত্রধর স্টেজের পেছনে গিয়ে লাইভ বাদ্য বাজিয়ে যাচ্ছে (আবহসঙ্গীত)। মাঝে মাঝে সবাই একসঙ্গে হয়ে চমৎকার সিনক্রোনাইজড এ্যাক্ট করে যাচ্ছে, এটা খুব চমৎকার লাগল। কোনো বাহুল্য নেই। নাটকের লাইটিং আর মিউজিক চালিয়ে নিচ্ছে নাটকের চরিত্রেরাই।

জুলেখার মুখে নিজের বাড়ির (বাবার) বর্ণনা ভালো লেগেছে। খুব দৃশ্যময়। যেন তার বাবা যখন গ্রাম থেকে শহরে আসে, মা আর তাকে ভিজিট করতে (অথবা, মায়ের বাবার সাথে ব্যবসায়িক আলাপ সারতে), সেই বর্ণনাগুলো খুবই উজ্জ্বল। যেন মনে মনে দেখা যায় সেই সময়গুলো। জুলেখা নাম্নী শিশুকন্যাটির চোখ দিয়েই। বিড়ালের মুখোশ পরা অভিনয় অত্যন্ত বিনোদন-সমৃদ্ধ। একটা মুখোশ আর তার সাথে সাথে উপযুক্ত অভিনয় যে কত অন্যরকম একটা মাত্রা নিয়ে আসতে পারে, এটা দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশ অভিভূত। যে কোনো মুখোশকে এরকম বাস্তবিক পরিস্থিতির সাথে অবলীলায় মিশে যাওয়াটা কখনোই এর আগে কোথাও দেখি নি।

          পরিস্থিতি

এত চমৎকার চমৎকার কাজ হচ্ছে, নিজেদের চিন্তা, আবেগ, ধারণা উস্কে দেবার মতো কাজ হচ্ছে, অথচ দর্শকদের মধ্যে ঢাকার নব্য কিংবা পুরনো লেখকশ্রেণির কাউকে কিংবা নব্য ইন্টেলেক চুয়ালদের কাউকে তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না কেন? অন্যান্যদের দৈনন্দিন লেখালেখিতে স্টেজ-নাটকের কথা উঠে আসে না কেন? পত্রপত্রিকা বা মিডিয়াতেই বা মঞ্চ-নাটক নিয়ে এত নীরবতা কেন? চমৎকার শিল্পমাধ্যম, আর এই মাধ্যমে নানা চমৎকার কাজের মধ্যে আরও একটি যুক্ত হলো `ডৌল`। অথচ যে রকম সাড়াশব্দ আশা করা সমীচীন, তার অনেকখানিই কিন্তু নাট্যপাড়ার বাইরে অনুপস্থিত।


ঢাকা শহরের পয়েন্ট জিরো ওয়ান পারসেন্ট (০.০১%) লোকেও যদি নাটক নিয়ে উৎসাহী হয়, থিয়েটার হলগুলোর সবগুলো মিলিয়েও তো স্থান সংকুলান হবার কথা নয় সারা সপ্তাজুড়ে। এখনকার অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক পরিস্থিতি বলে মনে হচ্ছে না। সম্ভাব্য দর্শকদের কাছে নাটকের খবর পৌঁছিয়ে দেয়া যাচ্ছে না। ডৌল নাটকটি সামনে আরও পরিবেশিত হতে হতে মানুষের চিন্তা, মনন ও আবেগকে উস্কে দিতে থাক। নানা ক্ষেত্রের সংস্কৃতিকর্মীরা, ইন্টেলেকচুয়ালেরা, দর্শকেরা, ছোছ-বড় সবাই মঞ্চনাটকে নিয়মিত গতায়াত করুক, এই কামনা করি। নাট্যকার, নির্দেশক আর চমৎকার দক্ষ কুশীলবদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।

রাদ আহমদ 

          কবি ও সম্পাদক 

ছাড়পত্র/ ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৮

ঢাকা

রেডিও স্বাধীন পডকাস্ট ডৌল,  পর্ব ৩

কোরক দর্শকের কল্পকথায়

এক   

পারস্যের জামি, তুরস্কের রুমি, বাংলার শাহ মুহম্মদ সগীরসহ এশিয়ার বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক এ-কাহিনি রূপ দিয়েছে বিভিন্নভাবে। ‘জুলেখা বাদশার মেয়ে, তাহার ভারি অহংকার’– শত শত বছর ধরে বাঙালির মুখে মুখে ফেরা এই বয়ানের উল্টোটা দেখানো হয়েছে এই অপেরাতে।

ডৌল দেখতে জগন্নাথ চারুকলার ছাত্রীরা
কাওসার হোসেন টগর, দিলরুবা পাপিয়ার সাথে
অপেরাতে দেখানো হয়েছে জুলেখা এক কৃষকের মেয়ে,যদিও জেরার এক পর্যায়ে জুলেখার মাকে জুলেখার বাবার রক্ষিতা হিসেবে সন্দেহ করেছেন জেরাকারী। এখানে জুলেখার জেরা পর্ব কোন আদালতে দেখানো হয়নি,দেখানো হয়েছে একটা ঘরে, রিমান্ড বলা যেতে পারে। যেখানে জুলেখাও একা,এবং জেরাকারীও একা,এই দুজন ব্যতীত নাই কোনো সাক্ষী, নাই কোনো উকিল।

এই জেরাকারীই জুলেখার সামনে এসেছে এক এক রূপে আর এভাবেই এক এক দৃশ্যে নাটকের মোড় পালটে চলে আসে এক ধরনের উত্তেজনাকর মুহূর্ত। আলো ছায়ার বেশ নিপুণ ব্যাবহারে প্রত্যেকটা দৃশ্যপট যেন অসাধারণ ভাবে ফুটে উঠেছে। আর সংলাপ গুলো যেন একই সাথে অনেক অর্থ বহন করেছে।

আর অভিনয় শিল্পীদের কথা কী বলে বোঝাবো? আপনিই ভাবুন কলমের কালিতে লিখা কাহিনী আপনি চোখের সামনে দেখছেন! এর কৃতিত্ব কাদের? কালির চরিত্রকে যারা জীবন্ত করছে তারাই তো! মাত্র তিনজন শিল্পী একইসাথে একাধিক জনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন,তবে আলোছায়ার খেলায় আর সংলাপ উপস্থাপনে যেন আলাদাভাবেই ধরা দিয়েছেন দর্শকের কাছে।


নিরাময়ী চক্রবর্তি

চারুকলা ছাত্রী

২০১৬, ঢাকা


দুই

"দেহের তাড়না,আত্মার কামনা আমরা কি দিয়ে লুকাই?"

"ডৌল-জুলেখার জেরা পর্ব" শীর্ষক মঞ্চ নাটকে প্রায় দেড় ঘণ্টা এ প্রশ্নের দোলাচলে মেতে রইলাম গত ২৫শে জানুয়ারি,২০১৮ শিল্পকলা একাডেমীর স্টুডিও হলে।সাথী ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পপিপাসু এক ঝাঁক সারথী!জন্মলগ্ন থেকে জেনে আসা তত্ত্ব ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চেনা গল্পকে অন্য চোখে দেখবার এক প্রয়াস চোখে পড়ল!দূর্দান্ত আলোর খেলা,শিল্পীদের পরিমিত ও চমতকার অভিনয়শৈলী,সুর-ছন্দের মিষ্টি,কখনো দৃঢ়, কখনওবা যাকে বলে "থ্রিল"এর আমেজ ভাল লেগেছে।

নাট্যকার রূপকের ছলে প্রশ্ন করেছেন,হাসির ছলে অভিনেতাকে দিয়ে তার চিন্তা ও অভিমত জানিয়েছেন বলে মনে হল। একে ধ্রুব সত্য মানি না,যথেষ্টই কন্ট্রোভার্সিয়াল ব্যাপার,তবে উপস্থাপনা দারুণ! আসমানী আশীর্বাদপুষ্ট ইউসূফের খুশিয়াল গৌরবান্বিত মুখের পাশে জুলেখার যাতনার গল্প...পাঠক,খুব কি ভেবে দেখি প্রতিদিন? দেবদূতের সাদা পাখার দিকে চেয়ে জুলেখার চিতকার,"অই পাখা আমি ছিঁড়ে ফেলব" কিন্তু ছুঁয়ে যায় দর্শককের মন! অভিনেতারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে দূর্দান্ত শব্দটি অর্জন করে নিয়েছেন।লেখক/পরিচালকও তাই!

এ নিয়ে দুবার দেখলাম। চটুল বাক্যে "পয়সা উসুল" প্রয়াস বললেও ভুল হবে না,ভাল লাগায় মেতে রইবেন পুরোটা সময়।


মুরাদ শিকদার

চারুকলা ছাত্র

২০১৮, ঢাকা



মহিলা সমিতি মঞ্চে ডৌল, ২০১৮     

মহিলা সমিতি মঞ্চে ডৌল, ২০১৮
শিল্পীদের সাথে দাঁড়িয়ে সর্ব ডানে রশীদ আমিন, বসে সর্ব ডানে বাবলী হক


ঢাকা শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে পরিসর-আর্ট সেন্টারের উদ্যোগে সেপ্টেম্বার ২০২২, ২৯শে বৃহস্পতিবার ও ৩০শে শুক্রবার, সন্ধ্যা ৭ টায় প্রদর্শিত হল বাংলাদেশের প্রথম অপেরা ধর্মি নাটক 'ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব'। চয়ন খায়রুল হাবিবের লেখা ও নির্দেশনায় নাটকটির প্রিমিয়ার হয়েছিল ২০১৬ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে। অভিনয়ে রয়েছেন পারভীন পারু, শিশির রহমান, জুনাইদ ইউসুফ। ২০১৮তে এই অনন্য নাটকটি আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল কয়েকজন বন্ধুসহ ।

আসমানি কিতাবের জুলেখা ইউসুফের প্রেম কাহিনি থেকে বেরিয়ে ভিন্ন  মেজাজের  'ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব'।  আজকের জুলেখা একজন সাধারণ বাদশা নামক কৃষকের মেয়ে। একজন শিশু সাহিত্যক। 'বাদশার মেয়ে জুলেখা' নামক বই লেখার অপরাধে তাকে ধরে আনা হয়েছে।

নাটক শুরু হয় জুলেখার শারীরিক ও মানসিক  নিপীড়নের জেরার নাটকীয় সংলাপে — “আমাকে ঘুম থেকে  তুলে আনা হয়েছে! চুলের মুঠিই ধরে টেনে হিঁচড়ে আনা হয়েছে। হাত মুচড়ে দেয়া হয়েছে।  পেটে লাথি মারা হয়েছে! সারা রাত ঠাণ্ডা একটা ঘরের মেঝেতে আমি পড়েছিলাম ! কী দোষে?  দোষ করলেই বা একজনের সাথে এরকম করা হবে কেন?"

 সংলাপ উচ্চারণ, প্রক্ষেপণ  ও গানের উপস্থাপনা  ছিল  মনোরম । গানের কথা রচনা করেছেন নাট্যকার নিজেই। শিশিরের কণ্ঠ ও সুর দর্শককে তন্ময় করে রাখে। অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখেন জুলেখা চরিত্রে পারভীন পারু, তার সামগ্রিক অভিনয় দক্ষতার জন্য।

মঞ্চে জুনায়েদ ইউসুফের অভিব্যক্তি ও অভিনয় ছিল সাবলীল। উপরন্ত জুনায়েদের মঞ্চ ও আলোর পরিকল্পনাও ছিল চমৎকার। মুষ্টিমেয় দর্শক  হলেও আমরা মুগ্ধ হয়ে একটি নিটোল মঞ্চ নাটক দেখেছিলাম। নাট্যকার ও কলাকুশীলবদের আন্তরিক শুভেচ্ছা অভিনন্দন জানাই। জুলেখা চরিত্রে পারভীন পারু, ইউসুফ চরিত্রে জুনায়েদ ইউসুফ, সূত্রধর বা গায়েন চরিত্রে শিশির রহমান এবং নাট্যকার চয়ন খায়রুল হাবিব- প্রত্যেকেই  যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের ভূমিকা পালন করেছেন। 

বাবলী হক
লেখিকা
২৮/৯/২২, ঢাকা


কোভিড পরবর্তি 'পরিসর আর্ট সেন্টারের' আয়োজন, ২০২২

ডৌল মঞ্চায়ন, শিল্পকলা একাডেমি, ২০২২।
শিল্পীদের সাথে শিশির রহমানের পাশে রফি হক, পাশে অধ্যাপিকা শাহনাজ পারভীন,
তার পেছনে ডক্টর রতন সরকার।বসে ও দাঁড়িয়ে সোহরোওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা।


বহুদিন পর, বহুদিন পর—দারুণ একটা সন্ধ্যা কাটিয়েছি। শুক্রবারের সন্ধ্যা। সেগুন বাগিচার শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে দেখলাম অপেরা ধর্মী নাটক—ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব।

ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম আমাদের জীবনে এতটাই দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে যে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ কারো সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে না, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার ব্যাপারটা তো উঠেই গেছে, শিল্প-সাহিত্যের আড্ডাতেও আজকাল যেতে পারিনা । আর্ট এগজিবিশন, সংগীতের সকল অনুষ্ঠান, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমির কোনো অনুষ্ঠানে আজকাল ইচ্ছে হলেও যেতে পারিনা । বাড়ি থেকে বের হলেই পাঁচ ঘন্টার মামলা। আর ভাগ্যের ফেরে পড়লে আট ন ঘন্টা ! সত্যি বলতে জীবন এতটা যন্ত্রণার হয়ে পড়েছে! রাস্তায় বের হতেই ভয় করে। তার ওপর আছে নানা রকমের জুজুর ভয়।

 শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রফেসর ডা. শাহনাজ পারভিন সাথী আপা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন চয়ন খায়রুল হাবিবের নাটক *ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব—দেখার। বলেছিলেন, রাফি ভাই চলে আসুন শিল্পকলা একাডেমীতে। চয়নের লেখা নাটক মঞ্চস্থ হবে আগামীকাল শুক্রবার সন্ধ্যে সাতটায় । ভালো লাগবে। আমার পঁচিশ জন ছাত্র-ছাত্রী নাটকটি দেখবে। রতন এসেছে জার্মানী থেকে—রতনও এলো।

আমরা শিশুকালে টেক্সট বোর্ডের বইতে পড়েছিলাম—জুলেখা বাদশাহ্র মেয়ে। তাহার ভারী অহংকার।… আবার আরও বড় হয়ে জেনেছি আসমানী কিতাবের ইউসুফ জুলেখার প্রেমকাহিনী । একটা গানও শুনেছিলাম এইরূপ—প্রেম কইরাছেন ইউসুফ নবী / তার প্রেমে জুলেখা বিবি গো…

কিন্তু চয়ন খায়রুল হাবিবের জুলেখা, অতি সাধারণ কৃষক বাদশাহ্‌র মেয়ে । জুলেখা লেখালেখি করে, মানে সাহিত্যিক । জুলেখা একটি বই লিখেছে, বইটির নাম : *জুলেখা বাদশাহ্‌র মেয়ে'।

এই বই লেখার অপরাধে জুলেখাকে ধরে এনে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নে জেরা করা হয় । এটাই জুলেখার জেরা পর্ব । এই জেরার ভেতর দিয়ে বিশ্বের কনটেম্পোরারি আর্ট, লিটেরেচার, মিউজিকের নানা অনুষঙ্গ প্রতীক বা উপমার মতো করে নাটকের সংলাপে উঠে এসেছে। খুব মজা লেগেছে। সচারচার এমন নাটক দেখা যায় না। সেট ডিজাইন, কস্টিউমস, প্রজেকশান, মিউজিকস, পারভীন পারু, জুনায়েদ ইউসুফের অভিনয়, শিশিরের কণ্ঠে মন্ত্রের মতো গান ভালো লেগেছে। এক কথায় নাটকটি আমাকে খুব মজা দিয়েছে। আনন্দ দিয়েছে। নাটকটি আরও একাধিকবার দেখার ইচ্ছে রইল। ধন্যবাদ, পরিসর-আর্ট সেন্টারের সকলকে।

রফি হক
শিল্পী ও শিল্পপত্র সম্পাদক
১/১০/২২, ঢাকা


''ডৌলঃজুলেখার জেরা পর্ব '' দেখে আমি খানিকটা মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছি। এ শিল্পিত গাঁথা বাংলাদেশে এখন যা চলছে তারই যেন প্রতিচ্ছবি। সামাজিক নৈর্ব্যক্তিকতা, পরিচয়ের রাজনীতি, নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙ্খা, কিংবা ব্যর্থ পৌরুষ, নারীর যাঞ্চা  এবং অনীহা সবই উপস্থিত। পূর্ব এবং পশ্চিম যেন এসে দাঁড়ালো একসাথে। আমার মনে হয়েছে চয়ন  পশ্চিমের অপেরার  স্রোতধারার জল স্পর্শ করেছে ।

বিশ্ব সাহিত্যের অনেক রেফারেন্স আছে যা আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে। সব দর্শক হয়তো এমন করে বুঝতে পারবে না। দর্শকদেরও নিজের যোগ্যতা বাড়াতে হবে। মঞ্চে উপস্থাপনের স্বার্থে সাজাতে গিয়ে নাটকটির সাহিত্যরুপ সম্পাদনা করা হয়েছে। কারণ নাটক দেখার পর দু’একটা জায়গায় আমার খটকা লাগছিলো, তখন বই খুলে দেখি, লেখায় আমি যেমনটি চাই তেমনি আছে। এর অন্যথা হবার কথা নয়। চয়নকে আমি দেখেছি আশির দশকের প্রেক্ষাপটে   স্বৈরাচারী সামরিক শাসক বিরোধী আন্দোলনের সাহসী যোদ্ধাদের কাতারে। সেসব দিনের জীবনমৃত্যু ফেরী করা বন্ধুদের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় তেমন করে হয়নি কিন্তু কমরেড হিসেবে প্রগাঢ় টান রক্তে অনুভব করি। এখনো সেসময়ের কারো সাথে দেখা হলে আদর্শিক চেনাজানা হয়ে যায়। 

অভিনয়ে সবার সততা ছিল, তবে মেলোড্রামা কম ছিল। সেটা আমার ভালোই লেগেছে। ছোট্ট পরিসরে ঠিক আছে।  এটা দেশের যে কোনো জায়গায় মঞ্চায়িত  করা যেতে পারে। 

রতন সরকার
শিক্ষক, গবেষক
অক্টোবার, ২০২২, ঢাকা

 শিল্পকলা একাডেমি ঢাকা, ২০২২,
শোর পর দর্শক ঘেরা জুলেখা
অষ্টম শ্রেণিতে প্রথম মঞ্চনাটক করেছিলাম। যেখানে সম্পূর্ণ নাটকটি ছিলো একটি স্কুল পড়ুয়া মেয়ের বেড়ে ওঠাকে ঘিরে। সেখানে মেয়েটি প্রতিবাদ করতে জানতো না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যত যাই হোক সব দোষই মেয়েদের, বারে বারেই তা মেয়েটির পারিপার্শ্বিক বুঝিয়ে দিয়েছিলো।

'ডৌল' জুলেখার জেরা পর্ব শীর্ষক অপেরাটিতে চয়ন খাইরুল হাবিব জুলেখা চরিত্রে একজন প্রতিবাদী নারীকে ফুটিয়ে তুলেছেন যিনি কিনা অনায়াসে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে সাহস দেখিয়ে গিয়েছেন। যেটা কিনা আমি নিজেই সেই আমার প্রথম মঞ্চনাটকে চুপচাপ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সকল অত্যাচার মেনে নেওয়া ওই স্কুল পড়ুয়া মেয়েটির মধ্যে দেখতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলাম।

এবার আসি নাটকের কথায়। নাটকটির যেই ব্যাপার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো যখন সংলাপ পর্যায় থেকে গান,আবার গান থেকে সংলাপ আসছিলো। রুপান্তরগুলো এতো বেশি নিখুঁত ছিলো যা সত্যিই মন কেড়েছে। সংলাপের মাঝে মাঝেই গানগুলো দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেছে।

নাটকটির আরো যেই বিষয় ভালো লেগেছে তা হলো নাটকের চরিত্রগুলো নিজেরাই প্রকাশ্যেই ব্যাকস্টেজের বিভিন্ন কাজ যেমন লাইটিং নিয়ন্ত্রণ, স্টেজের পেছনে গিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজানো ইত্যাদি করে যাচ্ছিলেন। মাঝেমাঝে সবাই একসঙ্গে তাল মিলিয়ে সুরের পসরা তুলছেন,যেটি দারুণ লেগেছে। মোটকথা দর্শকদের মনের খোরাক খুব দক্ষভাবেই মেটানো হয়েছিলো। নাটকটিকে সাধারণের মাঝে অসাধারণ করে তোলার ক্ষেত্রে এই ব্যপারগুলো সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে।


শামীমা জাহিদ প্রীতি

চিকিৎসা বিদ্যা ছাত্রী

২০২২, ঢাকা


ঢাকা রেকর্ডিং স্টুডিও, ২০১৭।নির্দেশকের সাথে।

ডৌল জুলেখার জেরা পর্ব*
রচনা ও নির্দেশনা, চয়ন খায়রুল হাবিব

অভিনয়ে :

পারভীন পারু, জুনাইদ ইউসুফ, শিশির রহমান


মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জুনাইদ ইউসুফ

সুর সংযোজনা : শিশির রহমান

পোশাক পরিকল্পনা : লূবনা সাজিয়া আফরিন

পোস্টার ফটোগ্রাফি : নাইমুজ্জামান প্রিন্স

পোস্টার মডেল : পারভীন পারু

পোস্টার জলরঙ : রশীদ আমিন

পোস্টার গ্রাফিক্স : সৈয়দ গোলাম দস্তগীর

প্রথম মঞ্চায়নের ব্যাবস্থাপক : চন্দন অমি


প্রযোজনা, ২০১৬

JSRL, জুলেখা সিরাপ রিডার্স লাউঞ্জ

প্রযোজনা, ২০২২

পরিসর আর্ট সেন্টার


*ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব', চয়ন খায়রুল হাবিব রচিত ও 'জাগৃতি' প্রকাশিত 'জুলেখা ট্রিলজি'র সার্বভৌম দ্বিতীয় অংশ।


সম্পাদনা, তরঙ্গ


জুলেখা ট্রিলজি, চয়ন খায়রুল হাবিব।প্রকাশক, জাগৃতি।


মহড়ার পর শিল্পকলা একাডেমি কোরিডোরে, সেপ্টেম্বার, ২০২২।
পারভীন পারু, শিশির রহমান, জুনাইদ ইউসুফ।