ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, June 11, 2022

নগ্নতার নৃতত্ব : লেন্সে, তুলিতে, দ্বিধায়

।।রুথ বের্নহার্ড।।ইমোজেন কানিংহাম।।সান্দ্রো বত্তিচেল্লি।।

।।পল সেজান।।রনোয়া।।ফ্রিদা কাহলো।।

।।অমৃতা শেরগিল।।ভূপেন খাখার।।


ইমোজেন কানিংহাম

নগ্নতার নৃতত্ত্ব

নৃতত্ত্ববিদরা মনে করে, আদিম মানুষ নগ্ন অবস্থায় থাকত। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে সম্ভবত ৭২,০০০ বছর আগেই মানব সমাজে নগ্নতা নিবারণের জন্য পোশাকের ব্যবহার শুরু হয়। বাইবেলে বর্ণিত আদম ও ইভের উপাখ্যান অনুযায়ী, ঈশ্বর প্রথম নর ও নারীকে নগ্ন অবস্থায় সৃষ্টি করেছিলেন; এবং নগ্নতার জন্য তাদের মনে কোনো লজ্জা ছিল না। পরে শয়তান কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করে তারা যখন জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে, তখন তাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয় এবং নিজেদের নগ্ন দেখে তারা লজ্জিত হয়ে পড়ে।


মিশরে পিরামিডের ভেতরে পাওয়া নগ্ন বাদকেরা।

আদি বাইবেলে ফ্যারাও-শাসনাধীন মিশর ও ইহুদিদের একটি বর্ণনা থেকে এই চিত্র পাওয়া যায়: "আসিরিয়ার সম্রাট এই দুই দেশ [মিশর ও সুদান] থেকে বন্দীদের বিবস্ত্র অবস্থায় নিয়ে যাবে। যুবা-বৃদ্ধ সকলকেই নগ্ন পদে বিবস্ত্র অবস্থায় পথ চলতে হবে, তাদের অনাবৃত নিতম্ব মিশরের লজ্জার কারণ হবে।"


প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য

প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় খেলাধুলা ও সংস্কৃতির জগতে পূর্ণবয়স্ক ও কিশোরদের নগ্নতার সৌন্দর্যের দিকটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বালক, নারী ও বালিকাদের নগ্নতাও প্রশংসা পেত। গ্রিকদের সৌন্দর্য চেতনায় প্রকৃতি, দর্শন ও শিল্পের পাশাপাশি মানবদেহেরও বিশেষ স্থান ছিল। গ্রিক শব্দ জিমন্যাসিয়াম কথাটির অর্থ ছিল "যেখানে নগ্ন অবস্থায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়"। পুরুষ খেলোয়াড়রা নগ্ন অবস্থায় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। কিন্তু সেযুগে অধিকাংশ নগররাষ্ট্রেই নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, এমনকি দর্শকাসনে উপস্থিত থাকার অনুমতিও ছিল না। তবে স্পার্টা ছিল এর এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। রোমানরা গ্রিক সংস্কৃতির অনেক রীতিনীতি গ্রহণ করলেও, নগ্নতা সম্পর্কে তাদের মানসিকতা পৃথক ছিল। সাধারণ স্নানাগার বা সাধারণ শৌচাগার ছাড়া অন্যত্র নগ্নতাকে অনুচিত আখ্যা দেওয়া হত।

খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে খ্রিষ্টধর্ম রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষিত হলে গ্ল্যাডিয়েটর ক্রীড়া ধীরে ধীরে উঠে যায় এবং প্রাপ্তবয়স্কদের নগ্নতা পাপের পর্যায়ে পর্যবসিত হয়। খ্রিষ্টধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি প্রথায় পরিণত হয়। যদিও অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপে খ্রিষ্টানরা নগ্ন অবস্থায় ব্যাপ্টাইজড হতেন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে সেন্ট বেনেডিক্ট অফ নার্সিয়া তার নিয়মাবলিতে সন্ন্যাসীদের তাদের ডরমিটরিতে সম্পূর্ণ পোশাক পরিহিত অবস্থায় ঘুমানোর পরামর্শ দেন। পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় পুরুষেরা মূলত আলখাল্লা জাতীয় পোশাক পরতেন; তারপর কডপিস, টাইটস ও টাইট ট্রাউজার্সের প্রচলন হয়। এই পোশাকগুলি পুরুষাঙ্গকে ঢেকে রাখলেও তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করত।


নগ্নতা বলতে কোন পোশাকহীন শারীরিক অবস্থাকে বোঝায়। প্রধানত মানুষের বৈশিষ্ট হল পোশাক পরিধান, যার প্রয়োজনীয়তা কার্যকরী চাহিদা থেকে উদ্ভূত, যেমন বাহ্যিক উপাদান, ঠান্ডা এবং তাপ থেকে সুরক্ষা, শরীরের চুলের ক্ষতি রোধ, এবং শীতপ্রধান অঞ্চলে বসবাস ইত্যাদি। পোশাক পরিধান সাধারণত উষ্ণতা বা উপাদান থেকে সুরক্ষা এবং সামাজিক বিবেচনার উপর নির্ভর করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, নূন্যতম পোশাক বা পোশাকহীন অবস্থা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে। সাধারণভাবে শালীনতাবোধ নগ্নতাকে সমর্থন করে না। তবে স্থান ও কাল ভেদে শালীনতাবোধের ধারণা বিভিন্ন। সভ্য সমাজে যা শালীন, আদিম সমাজে তা বিপরীত। কোনো কোনো নির্দিষ্ট সমাজব্যবস্থায় চিত্রে, ভাস্কর্যে ও সাহিত্যে নগ্নতাকে নান্দনিকতার এক বিশেষ উপাদান মনে করা হয়।


ম্রোদের নিস্ক্রান্ত নগ্নতা

মুরং বাংলাদেশের একটি প্রাচীন জাতিগোষ্ঠি ও আদিবাসী হিসেবে পরিচিত। মুরুং শব্দটি বহুবচন যার একবচন হল ‘ম্রো’। ‘ম্রো’ শব্দের অর্থ মানুষ, মানব জাতি, মানব সত্ত্বা। ম্রো ভাষায় ‘ম্রো’রা নিজেদের ‘ম্রোচ’ বলে থাকে। মুরুংদের ভাষা মৌখিক, বর্তমানে ‘ম্রোচ চা’ বা ম্রো বর্ণমালা আবিষ্কৃত হওয়ায় তাদের নিজস্ব লিখিত ভাষা রয়েছে।


ম্রো পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রাচীন নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি এবং বান্দরবান জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিসত্বা। ম্রোদের আদি নিবাস মায়নামারের আরাকান রাজ্য। আনুমানিক ১৪৩০ খ্রিঃ অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫৯২ বছর আগে ম্রোরা বান্দরবান জেলার লামা, আলীকদম, থানছি ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় আশ্রয় নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। ম্রোরা মূলতঃ প্রকৃতি পূজারী হলেও অধিকাংশই 'বৌদ্ধ' ধর্মাবলম্বী এবং 'খিস্টান' ধর্ম পালন করে। তবে কয়েক বছর আগে ম্রোদের মধ্যে একটা নতুন ধর্ম ‘ক্রামা’ আর্বিভাবের ফলে বর্তমানে ম্রোদের একটি অংশ ক্রামা ধর্মের অনুসারি।

কর্মরত ম্রো রমনী, বাংলাদেশ।

মুরংরা অত্যন্ত স্বল্পবসন পরিধান করে (তবে বর্তমানে ব্যবহার নেই)। মেয়েরা ‘ওয়ানক্লাই’ নামে একধরনের ছোট পরিধেয় ব্যবহার করে। যা নাভীর নীচ থেকে হাঁটুর উপরিভাগ পর্যন্ত পড়ে থাকে। এটি ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়ামাত্র। মেয়েরা পায়ে “খক খ্যান” (নুপুর) কোমরে ‘‘রোওয়া কম” (বিছা) পড়ে থাকে। পুরুষগণ ‘ডং’ (লেংটি-বিদ্রি) নামে একধরনের কিঞ্চিতকর বস্ত্র পরিধান করে। মুরুং মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও মাথায় লম্বা চুল রাখে। নারী-পুরুষরা মাথায় অধিকন্তু “ছুরুত” (চিরুনী) গেঁথে রাখতে দেখা যায়। মুরুং মেয়েরা মাথায় কানে ও খোঁপায় বিভিন্ন ধরনের “পাও” (পাহাড়ী ফুল) গুজে রাখে। ছেলেরাও মাথার চুলকে খোপা আকারে বেঁধে রাখে। মুরংরা দাঁতের মধ্যে এক ধরনের রংয়ের প্রলেপ দিয়ে থাকে। লোহাকে উত্তপ্ত করে কাঁচা বাঁশের সাথে লাগিয়ে নির্গত রসকে দাঁতে লাগিয়ে দেয়। মুরুং সম্প্রদায়ের ছেলে একই গোত্রের কোন মেয়েকে বিবাহ করতে পারেনা। মুরুং সমাজে তিন পদ্ধতিতে বিবাহ হয়ে থাকে। রীতি অনুযায়ী মুরুং ছেলে কন্যার দেহের মূল্য বাবদ রৌপ্য মুদ্রায় ১০১/= টাকা, মায়ের দুধের দাম বাবদ ১০/= টাকা প্রদান করতে হয়। এসব রৌপ্য টাকা অবশ্য পরিশোধনীয় বলে গণ্য করা হয়। একই গোত্রের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে বিবাহ নিষিদ্ধ। মুরুং দম্পতির মধ্যেও মনের মিল না থাকলে তালাক প্রথা বিদ্যমান রয়েছে।

 

শাস্তি

ডাইনি বা উইচ  শিকারের সময় অভিযুক্ত ডাইনিদের নগ্ন করে তথাকথিত ডাইনি চিহ্নগুলি পরীক্ষা করা হত। এই সব চিহ্ন তাদের বিরুদ্ধে বিচারের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হত। নগ্নতা (সম্পূর্ণ বা অংশত) শারীরিক শাস্তির অংশ হতে পারে। জনসাধারণের সামনে কাউকে অপমান করার ক্ষেত্রেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই শাস্তির ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নাৎসিরা তাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীদের জোর করে নগ্ন করে রাখত। এই ঘটনা শিন্ডলারস লিস্ট নামক চলচ্চিত্রে বর্ণিত হয়েছে। ২০০৩ সালে ইরাকের আবু গারিব কারাগারে কুখ্যাত বন্দী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। মার্কিন সেনা কর্মচারীরা এখানে বন্দীদের নগ্ন করে, কখনও বেঁধে ও ভয় পাইয়ে দিয়ে তার ফটো তুলে রেখেছিল।


নগ্ন ফটোগ্রাফি

ফটোগ্রাফি আবিষ্কারের সময় থেকে তাতে নগ্নতার ব্যবহার প্রচলিত। ফটোগ্রাফিতে নগ্নতার মধ্যে সবসময় শৈল্পিক মেধা বিকশিত না হলেও, নগ্ন ফটোগ্রাফি বা ন্যুড ফটোগ্রাফিতে হয়ে থাকে। ফটোগ্রাফিতে নগ্নতা সাধারণত স্ন্যাপশট; কিন্তু নগ্ন ফটোগ্রাফি কোনো ব্যক্তির স্থির অবস্থায় তোলা ছবি। শিল্পকৃতি হিসেবে, নগ্ন ফটোগ্রাফি হল নগ্ন দেহের শৈল্পিক প্রদর্শন। এখানে মানবদেহের রেখা ও রূপই প্রধান উদ্দেশ্য।


রুথ বের্নহার্ড

অনেক ফটোগ্রাফারই একটি আর্ট ন্যুড ফটোগ্রাফকে ব্যক্তির বদলে মানবদেহের পাঠ মনে করেন। ব্যক্তির ফটোগ্রাফ, যেখানে তাকে চেনার উপায় থাকে, তাকে পোর্ট্রেট বলা চলে। কিন্তু অনেক ন্যুড ফটোগ্রাফে ব্যক্তির মুখই দেখা যায় না। ফটোগ্রাফারেরা অনেক সময় আলোছায়ার চরম ব্যবহার, তৈলাক্ত ত্বক অথবা দেহের গঠন বোঝাতে ছায়ার ব্যবহার করে থাকেন। প্রথম যুগের ফটোগ্রাফাররা অনেক সময়ই নারীদের নগ্নতা ফটোগ্রাফিতে ফুটিয়ে তুলতেন। এদের মধ্যে ফেলিক্স-জ্যাক মলিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এডওয়ার্ড ওয়াটসন, রুথ বের্নহার্ড, ইমোজেন কানিংহাম, জেরি অ্যাভেনেইম প্রমুখ ফটোগ্রাফাররা শিল্পকর্ম হিসেবে দেহের রেখা প্রদর্শন করতে পছন্দ করতেন।


ইরোটিক ফটোগ্রাফি ও পর্নোগ্রাফিতেও অনেক সময় নগ্ন বা অর্ধনগ্ন মডেলদের শৈল্পিক চিত্র বিধৃত হয়ে থাকে।স্পেনসার টিউনিক নির্মিত সারা বিশ্বের নানা প্রকাশ্য স্থানে এক দঙ্গল নগ্ন লোকের স্থিতিস্থাপক ফটোগ্রাফি উচ্চ মানের শিল্পমেধার জন্য নন্দিত।


প্রাকৃত নগ্নতা

অল্পসময়ের জন্য আবশ্যকীয় নগ্নতাকে (যেমন সৈকতে পোশাক পরিবর্তন) অশালীন মনে করা হয় না। তবে সৈকতে দীর্ঘক্ষণ নগ্ন অবস্থায় থাকাটা অশালীন বলে বিবেচিত হয়। যদিও নগ্ন সৈকতগুলিতে নগ্নতা গ্রহণযোগ্য। পাশ্চাত্য সমাজে নারীদের প্রকাশ্যে স্তন্যপান করানোয় অনেক ক্ষেত্রে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ২০০৭ সালের জুন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্রুক রায়ান নামে জনৈক মহিলা একটি রেস্তোরাঁয় তার সাত মাসের শিশুপুত্রকে স্তন্যপান করাতে গেলে রেস্টুরেন্টের মালিক আপত্তি জানান। সেদেশে প্রকাশ্যে স্তন্যপান করানো যে আইনসঙ্গত সেই সংক্রান্ত একটি নথি দেখিয়েও তিনি মালিকের অনুমতি পাননি। অগত্যা তাকে গাড়ির মধ্যে পুত্রকে স্তন্যপান করাতে হয়। পরে তিনি ওই রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন।উল্লেখ্য, অধিকাংশ মার্কিন অঙ্গরাজ্যেই (২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের হিসেব অনুযায়ী ৪০টি) মায়েদের প্রকাশ্যে সন্তানকে স্তন্যপান আইনসঙ্গত।


নগ্নতাবাদ

নগ্নতাবাদ (ইংরেজি: Naturism বা nudism) একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের নাম। এই আন্দোলন সর্বসমক্ষে ও প্রকাশ্যে নগ্নতাকে সমর্থন জানায় এবং তার সপক্ষে মতপ্রকাশ করে। শালীনতার যে প্রচলিত ধারাটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক নগ্নতার বিরোধী নগ্নতাবাদীরা তা প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। পরিবর্তে তারা এমন এক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চান যেখানে মানুষে নগ্ন মানুষের সাহচর্যে অথবা অন্যান্য নগ্নতাবাদী বা সাধারণ মানুষের সামনে নগ্ন হয়ে থাকতে অস্বস্তিবোধ করবে না।


জলকেলি

এই প্রথানুযায়ী ইউরোপের অনেক দেশে (বিশেষত জার্মানি, ফিনল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডে) উভয় লিঙ্গের মানুষেরই দলবদ্ধ অবস্থায় নগ্ন হয়ে স্নান স্বীকৃত। অধিকাংশ জার্মান স্পা-তে মিশ্র নগ্ন স্নানের অনুমতি দেওয়া হয়। জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন ও গ্রিসের সৈকত ও সুইমিং পুলগুলিতে নগ্ন হয়ে স্নান অনুমোদিত। উল্লেখ্য, মহাদেশীয় ইউরোপে নগ্নতাকে অ্যাংলো-স্যাক্সন জগতের রক্ষণশীলতার তুলনায় অনেক লঘু করে দেখা হয়। সনা ব্যবস্থার উৎস ফিনল্যান্ডে। এই দেশে এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য জার্মান-ভাষী রাষ্ট্রে সনায় নগ্ন অবস্থান অনুমোদিত। সনা বর্তমান ফিনল্যান্ডে অতি সুপরিচিত। এখানে বর্তমানে প্রতি তিন জন নাগরিকের জন্য একটি করে সনা রয়েছে। বিগত কয়েক দশকে সমগ্র ইউরোপেই সনা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।


নগ্ন ভ্রমণ

বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে একা বা দলগতভাবে ভ্রমণ।স্টিফেন গগ্ ( 'নগ্ন ভবঘুরে' নামে আখ্যায়িত) ২০০৩/২০০৪ সালে ইউনাইটেড কিংডমের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত যাত্রা করেন শুধুমাত্র জুতো পরা অবস্থায়। তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হন এবং তার ভ্রমণ দুবার বাধাপ্রাপ্ত হয় জেলবন্দী হওয়ার জন্য।নগ্নতা সম্বন্ধে মানুষের দৃষ্টিপ্রসারিত করতে তার এই উদ্যোগ ছিল।তিনি দেখেছিলেন স্কটল্যান্ডে ইংল্যান্ডের থেকেও নগ্নতা-বিরোধী আইনকানুন দৃঢ়তর।অবশেষে ২০০৬ সালের প্রথমার্ধে বহু বাধা অতিক্রমের পর তার ভ্রমণ শেষ করেন।


যৌনতা

যৌনসঙ্গীর সম্মুখে নগ্নতা সামাজিকভাবে অনুমোদিত; তবে সব ক্ষেত্রে নয়। উদাহরণ স্বরূপ, কেউ কেউ কেবলমাত্র যৌনসঙ্গমের সময়ই আলোতে বা অন্ধকারে নগ্নতাকে অনুমোদন করেন। এছাড়া সঙ্গীর সঙ্গে স্নানের সময় বা স্নানের পরে, চাদর বা কম্বলের আবরণের অন্তরালে, অথবা ঘুমানোর সময় সঙ্গীর সম্মুখে নগ্নতা অনুমোদিত।


কামসূত্র 
(সংস্কৃত: कामसूत्र বা কামসূত্র, Kāmasūtra) প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিত মল্লনাগ বাৎস্যায়ন রচিত সংস্কৃত সাহিত্যের একটি প্রামাণ্য মানব যৌনাচার সংক্রান্ত গ্রন্থ। গ্রন্থের একটি অংশের উপজীব্য বিষয় হল যৌনতা সংক্রান্ত ব্যবহারিক উপদেশ। গ্রন্থটি মূলত গদ্যে লিখিত; তবে অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত অনেক পদ্যাংশ এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। কাম শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয়সুখ বা যৌন আনন্দ; অপরদিকে সূত্র শব্দের আক্ষরিক অর্থ সুতো বা যা একাধিক বস্তুকে সূত্রবদ্ধ রাখে। কামসূত্র শব্দটির অর্থ তাই পুস্তকের আকারে এই জাতীয় উপদেশমালার গ্রন্থনা। এতে রমণীদের জন্য প্রযোজ্য চৌষট্টি কলা বিবৃত হয়েছে।


কামশাস্ত্র সাহিত্যধারার প্রাচীনতম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল কামসূত্র। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে শিবের দ্বাররক্ষক নন্দী কামশাস্ত্রের আদিরচয়িতা। তিনি শিব ও তার পত্নী পার্বতীর রমণকালে উচ্চারিত পবিত্র বাণী শুনে মুগ্ধ হন। পরে মানবজাতির কল্যাণার্থে সেই বাণী লিখে রাখেন। ঐতিহাসিক অনেকে মনে করেন, কামসূত্র একটি সারগ্রন্থ যা খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে তার বিভিন্ন রচনাসূত্র থেকে সংকলিত হয়ে তার বর্তমান রূপটি লাভ করে।


অজন্তা গুহাতে নগ্ন ভাস্কর্য

অজন্তা ইলোরার নগ্ন আধ্যাত্ম

অজন্তা গুহাসমূহ ভারতের মহারাষ্ট্রে গভীর খাড়া গিরিখাতের পাথর কেটে খোদাই করা প্রায় ৩০টি গুহা-স্তম্ভ। এগুলো খ্রিষ্টপূর্ব দোসরা শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।[১][২] এগুলোতে পাওয়া ছবি ও ভাস্কর্য, তৎকালীন বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। অজন্তার দেয়ালের চিত্রগুলিতে বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।১৮১৯ সালে একটি ব্রিটিশ বাঘশিকারের দল দ্বারা পুনরাবিষ্কৃত হবার আগে অবধি, অজন্তাগুহা ধীরে ধীরে বিস্মৃতিতে তলিয়ে গিয়েছিল।চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণলিপিতে অজন্তার বর্ণনা আছে। 


ইলোরা ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের অন্তর্গত একটি গ্রামবিশেষ। ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে হোলকার এ গ্রামটি তৎকালীন ইংরেজ শাসকশ্রেণীর কাছে প্রদান করেছিলেন। কিন্তু ৪ বছর পর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী পুনরায় গ্রামটিকে হায়দ্রাবাদের সন্ধির শর্ত অনুসারে নিজামের কাছে প্রদান করেন। ইলোরার অপর নাম ইলুক বা বিরুল।


ইলোরার গিরিগাত্রে খোদিত বা ভাস্কর্যচিত্রে অঙ্কিত গুহাগুলো সমগ্র পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে আছে। ইলোরার খোদিত কাজগুলো পাহাড়ের ঢালু গাত্রের উপরেই দৃশ্যমান। আর অজন্তা গুহার খোদিত কার্য লম্বমান পাহাড়ের গাত্রে রয়েছে।[১] খোদিত অংশের বিস্তৃতি ১|০ মাইল। খোদিত কাজগুলো তিনটি পৃথক অংশে বিভাজিত - বৌদ্ধ, হিন্দু ও জৈন। অন্তিম অর্থাৎ উত্তর দিকে জৈন পর্যায় যা ইন্দ্রসভা নামে পরিচিত। এর অন্তর্গত একটি সুবিশাল জৈন মুর্তি বিদ্যমান।


জৈন ধর্মে নগ্নতা ও নারীদের মোক্ষলাভে বিতর্ক

জৈন ধর্ম (প্রথাগত নাম জিন সাশন বা জৈন ধর্ম) হল একটি ভারতীয় ধর্ম। এই ধর্ম সকল জীবিত প্রাণীর প্রতি অহিংসার শিক্ষা দেয়। জৈন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন অহিংসা ও আত্ম-সংযম হল মোক্ষ এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিলাভের পন্থা। "জৈন" শব্দটি এসেছে সংস্কৃত "জিন" (অর্থাৎ, জয়ী) শব্দটি থেকে। যে মানুষ আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, অহংকার, লোভ ইত্যাদি আন্তরিক আবেগগুলিকে জয় করেছেন এবং সেই জয়ের মাধ্যমে পবিত্র অনন্ত জ্ঞান (কেবল জ্ঞান) লাভ করেছেন, তাঁকেই "জিন" বলা হয়। "জিন"দের আচরিত ও প্রচারিত পথের অনুগামীদের বলে "জৈন"।


জৈনধর্ম শ্রমণ প্রথা থেকে উদ্গত ধর্মমত। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মমতগুলির অন্যতম।[৬] জৈনরা তাঁদের ইতিহাসে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের কথা উল্লেখ করেন। এঁদের শিক্ষাই জৈনধর্মের মূল ভিত্তি। প্রথম তীর্থঙ্করের নাম ঋষভ এবং সর্বশেষ তীর্থঙ্করের নাম মহাবীর।


দিগম্বর জৈন ধর্মের দুটি সম্প্রদায়ের একটি। অন্যটি হলো শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়। দিগম্বর সন্ধি বিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় দিক্‌ + অম্বর। অর্থাৎ 'দিগম্বর' অর্থ হলো দিক বা আকাশ যার অম্বর বা বস্ত্র।দিগম্বর সম্প্রদায়ের অনুসারীগণ মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য নগ্নতাকে মুখ্য গণ্য করে এবং নারীদের মোক্ষ স্বীকার করে না। তারা শ্বেতাম্বরদের ৪৫ গ্রন্থকেও স্বীকার করে না।দিগম্বরদের বিপরীতে শ্বেতাম্বররা সন্ন্যাসী বা মুনিদের জন্য নগ্নতা চর্চা অত্যাবশ্যক মনে করেন না।  শ্বেতাম্বরগণএও বিশ্বাস করে যে নারীরা মোক্ষ অর্জন করতে সক্ষম। শ্বেতাম্বররা মনে করেন যে ১৯ তম তীর্থংকর, মালিনাথ, একজন নারী ছিলেন।


মল্লিনাথ বা মল্লিনাথ বা মল্লিকুমারী বা মল্লি ১৯ তম জৈন তীর্থঙ্কর। জৈন ধর্মের ধর্মগুরুরা তীর্থঙ্কর বলে পরিচিত। মোট ২৪ জন তীর্থঙ্করদের মধ্যে ১৯তম হলেন মল্লিনাথ বা মল্লিকুমারী বা মল্লি৷ জৈন ধর্মের শ্বেতাম্বর শাখার প্রাচীন পুঁথিপত্র অনুযায়ী মল্লিকুমারী ছিলেন একমাত্র মহিলা তীর্থঙ্কর৷ আবার জৈন ধর্মের অপর শাখা দিগম্বর মতে, মল্লিনাথসহ সব তীর্থঙ্কর পুরুষ ছিলেন৷ মল্লি প্রথম জীবনে মিথিলা রাজ্যের রাজকুমারী ছিলেন। 


ভেনাসের জন্ম

প্রেম,কাম, যৌনতার এই দেবী গোটা দেবপুরীতে ফেলে দিয়েছিলেন সাড়া। তাঁর স্বামী হওয়ার জন্য ব্যগ্র ছিল প্রায় প্রতিটি দেবতা। স্বর্গীয় সৌন্দর্য আর প্রেমের দেবী হিসেবে গ্রিক ও রোমান পুরাণে জনপ্রিয় আফ্রোদিতি বা ভেনাস।


সান্দ্রো বত্তিচেল্লি।ভেনাসের জন্ম।

সৌন্দর্যের এই দেবীর জন্ম নিয়ে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁকে দেবরাজ জিউস ও দেবী ডিওনের কন্যা মেনে নেয়া হয়। এছাড়া ইউরেনাসের কাহিনীও বেশ আলোচিত। এতে জানা যায়, সময়ের দেবতা ক্রনস ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তাঁর পিতা ইউরেনাসের জননাঙ্গ কেটে পৃথিবীর সপ্তসমুদ্রে ফেলে দেন। ইউরেনাসের প্রভাবে ক্রমে সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে আর এর মধ্য থেকেই উঠে আসে অনিন্দ্য সুন্দরী এক দেবী– আফ্রোদিতি বা ভেনাস। গ্রিক ভাষায় আফ্রোদিতি শব্দের অর্থই হলো ‘সমুদ্রোদ্ভুতা’ মানে যার জন্ম সমুদ্র থেকে। ভেনাস নামটি রোমানদের দেয়া। এই ভাষ্যে ভেনাসের বাড়ি সাইথেরা ও সাইপ্রাস দ্বীপে। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় তিনি ইজিয়াস সাগর পার হয়ে মূল ভূখণ্ডে আসেন।


গ্রিক কবি হিসিওড প্রথম তত্ত্বের পক্ষে গেলেও সাহিত্যিক হোমার ইউরেনাসের তত্ত্বেই বিশ্বাসী। তবে এটাই শেষ নয়।  দার্শনিক প্লেটো আরও দুই ধাপ এগিয়ে আরেক তত্ত্ব দাঁড় করান। তাঁর মতে একই নামে দুই আফ্রোদিতি বিদ্যমান ছিল দেবালয়ে। এর একজন ছিল ‘স্বর্গীয় প্রেমের দেবী’, আর অপরজন ছিল ‘দৈহিক প্রেমের দেবী’। এই দুই ধারার প্রথমটি পরিচিত ‘ইউরানিয়াম’ নামে– যা প্রেমের বিশুদ্ধ রূপটি তুলে ধরে। অন্যদিকে ‘প্যান্ডিমিয়ান’ হলো দেহগত ইন্দ্রিয়–লালসার রূপ।


সান্দ্রো বত্তিচেল্লির আঁকা সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্ম হল দ্য বার্থ অব ভেনাস (The Birth of Venus)। এটি পনের শতকের ইতালিয়ান আর্টের অন্যতম দৃষ্টান্ত। ঝিনুকের তরী বেয়ে সাগরের বুকের গহন থেকে  উঠে আসছে দেবী ভেনাস। একই আঙ্গিকে আঁকা বত্তিচেল্লির আরেকটি বিখ্যাত শিল্পকর্মের নাম প্রিমাভেরা(১৪৮২)।


অন্তর্মুদ্রাবাদী বা ইম্প্রেশানিস্ট নগ্নতা

পল সেজান  (ফরাসি: Paul Cézanne) (জানুয়ারি ১৯, ১৮৩৯-অক্টোবর ২২, ১৯০৬) ছিলেন ফরাসি চিত্রশিল্পী ও উত্তর-অন্তর্মুদ্রাবাদ (পোস্ট-ইমপ্রেশনিজম) ধারার নেতৃস্থানীয় শিল্পী। পিয়ের-ওগ্যুস্ত রনোয়াও (ফরাসি: Pierre-Auguste Renoir; ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৪১ – ৩ ডিসেম্বর ১৯১৯) ছিলেন অন্তর্মুদ্রাবাদী ঘরানার একজন অন্যতম প্রধান ফরাসি চিত্রশিল্পী। চিত্রকলায় অন্তর্মুদ্রাবাদ বা প্রতিচ্ছায়াবাদের (ইমপ্রেশনিজম) প্রতিক্রিয়ায় যে কয়জন শিল্পী এঁকেছেন, পল সেজান, রনোয়া তাদের অন্যতম।


পিয়ের-ওগ্যুস্ত রনোয়া।স্নানরতা নারীগন।১৯১৮।

১৮৯২ থেকে ১৮৯৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে লে জুয়র দ্য কার্ত (Les Joueurs de Cartes অর্থাৎ "তাস খেলোয়াড়েরা") নামে পাঁচটি তৈলচিত্র নিয়ে সেজানের  সিরিজিটিকে ধরা হয় ১৮৯০ দশকের ‘ভিত্তি’ হিসেবে। ‘তাস খেলোয়াড়েরা’ ছবিতে সেজান মডেল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তার বাগানের মালি আর এক কৃষককে। ছবিতে দেখা যায়, পাথুরে মুখ নিয়ে দুই ব্যক্তি তাস খেলছেন। ২০১১ সালে কাতারের রাজপরিবার এ ছবিটি ২৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২১৭৬ কোটি টাকার বেশি) কিনে নেয়।


অন্তর্মুদ্রাবাদ, প্রতীতিবাদ, প্রতিচ্ছায়াবাদ বা ইংরেজি পরিভাষায় ইমপ্রেশনিজ্‌ম (Impressionism), ঊনবিংশ শতকে শুরু হওয়া একটি চিত্রকলা আন্দোলন। ১৮৬০-এর দশকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের কিছু তরুণ চিত্রশিল্পী নিজেরাই তাঁদের আঁকা ছবি প্রদর্শনীর জন্য ব্যবস্থা করেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টার সাথে অন্তর্মুদ্রাবাদের বেশ খানিকটা সম্পর্ক আছে। আন্দোলনের নাম ক্লোদ মনের একটি ছবির নাম থেকে এসেছে। ছবিটির নাম আঁপ্রেসিওঁ, সোলেই ল্যভঁ (Impression, soleil levant)। চিত্র সমালোচক লুই ল্যরোয়া এই ছবির নেতিবাচক সমালোচনা করেছিলেন এবং ছবি আঁকার এই ধরনটিকে ব্যঙ্গ করে "আঁপ্রেসিওঁ" নামে ডেকেছিলেন। ল্য শারিভারি (Le Charivari) পত্রিকাতে শব্দটি প্রকাশিত হওয়ার পর সবাই ধরনটিকে এ নামেই ডাকতে শুরু করে।


পল সেজান।স্নানার্থিদের ভিড়।১৮৯৮-১৯০৫।

অন্তর্মুদ্রাবাদের মূল কথা হলো বাস্তবতার নিরিখেই ছবি আঁকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কারণ বাস্তব প্রাকৃতিক দৃশ্য বা এ ধরনের অনেক কিছু নিয়েই ছবি আঁকা হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তব দৃশ্য শিল্পীর মনে যে অণুরণন জাগায়, তাকে তার নিজের কল্পনায় ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমেও ছবি আঁকা যেতে পারে। এভাবেই সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছবি আঁকা শুরু করেন প্যারিসের গুটিকতক তরুণ চিত্রশিল্পী। তাঁদের ছবির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল উজ্জ্বলভাবে তুলির ব্যবহার, উন্মুক্ত কম্পোজিশন, আলো এবং এর পরিবর্তনশীল মানের উপর গুরুত্ব প্রয়োগ, খুব সাধারণ বিষয়বস্তু, মানুষের অবধারণ ও অভিজ্ঞতা ফুটিয়ে তোলার জন্য চলনের ব্যবহার এবং ভিন্নরকম চাক্ষুষ দৃষ্টিকোণ।


চিত্রশিল্পে অন্তর্মুদ্রাবাদের উত্থান ঘটার পর শিল্পের অন্যান্য শাখায় একই ধরনের আন্দোলনের সূচনা ঘটে। এর মধ্যে আছে অন্তর্মুদ্রাবাদীয় সঙ্গীত এবং অন্তর্মুদ্রাবাদীয় সাহিত্য। শুধু ঊনবিংশ শতকের সেই সময়ের ছবিগুলোই নয়, বর্তমানে যেকোনো সময়ে ঐ ভঙ্গিতে আঁকা ছবিকেই অন্তর্মুদ্রাবাদের কাতারে ফেলা হয়।


লুসিয়ান ফ্রয়েডের নগ্ন নারীরা*

মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দৌহিত্র লুসিয়ান ফ্রয়েডের জন্ম ১৯২২ সালের ৮ ডিসেম্বর বার্লিনে। বাবা অস্ট্রীয় ইহুদি আর্নস্ট লুডভিগ ফ্রয়েড ছিলেন স্থপতি, মা জার্মান রমণী লুসি ব্রাশ। ফ্রয়েড পরিবারের (খ্যাতিমানের আধিক্যের কারণে কেউ কেউ ফ্রয়েড ডায়নেস্টিও বলে থাকেন) সমকালীন আর সব খ্যাতিমানদের তিনি ম্লান করে দিয়েছেন। তাঁর অসনাতন আচরণ কার্যত তাঁকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এমনকি নিজের খ্যাতিমান ভাইয়েরাও একসময় জানিয়ে দিয়েছেন, লুসিয়ান আসলে তাঁদের মায়ের অবৈধ সন্তান। নাৎসি জার্মানি থেকে রেহাই পেতেই ১৯৩৩ সালে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লন্ডনে চলে আসেন, ১৯৩৯ সালে নাগরিকত্ব লাভ করেন। 


লুসিয়ান ফ্রয়েড।বেনিফিট সুপারভাইজার স্লিপিং।

লুসিয়ান ফ্রয়েড বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী। একুশ শতকে পেঁৗছানোর পর অন্তত বার্ধক্যজনিত সীমাবদ্ধতার কারণে হলেও 'শ্রেষ্ঠ জীবিত শিল্পী'_অলিখিত এই উপাধিটি তাঁর পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হবে না বলে যাঁরা মনে করেছিলেন, তাঁরা বেশ বড় রকমের মার খেয়েছেন। ২০০৮ সালে তাঁর আঁকা মোটাসোটা ঘুমন্ত নারী 'বেনেফিটস সুপারভাইজার স্লিপিং' যখন নিলাম হাতুড়ির নিচে অবলীলায় তা বিক্রি হয়ে গেল ৩৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের সমমান পাউন্ড স্টার্লিংয়ে; আমাদের টাকায় ২৫২ কোটি টাকা। এটি বিশ্বরেকর্ড। কোনো শিল্পীর জীবদ্দশায় তাঁর আঁকা কোনো ছবি এত টাকা দিয়ে কেউ কখনো কেনেনি।


লুসিয়ান ফ্রয়েড।
সেজান অবলম্বনে।১৯৯ ২০০০।
তাঁর নগ্ন মডেলরা টিশিয়ানের নারীদের মতো সর্বাঙ্গসুন্দর নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্থূল ও থলথলে, কখনো কুৎসিতও। জব সেন্টারের সুপারভাইজার স্থূলদেহী সু টিলে ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে টানা চার বছর সপ্তাহে দু-তিন দিন নগ্ন শরীরে সোফায় এসে শুয়েছেন। স্থূলদেহী এই মহিলা ফ্যাট সু নামেই পরিচিত, প্রথম দিকে নগ্ন হয়ে শুতে বিব্রত বোধ করতেন, তারপর ব্যাপারটা খুব সহজ ও গা-সওয়া হয়ে যায়_এই চিত্রটিই ৩৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের 'বেনেফিটস সুপারভাইজার স্লিপিং'। সু নিজেও তাঁর স্থূলতা নিয়ে নিজেকে পরিহাস করেছেন। তিনি বলেছেন, এটা তো আশীর্বাদ যে ছবিতে আমাকে আরো স্থূল দেখানো হয়েছে। সে জন্যই ছবিটা বিশ্বরেকর্ড করল। লুসিয়ান ফ্রয়েড প্রিন্সেস ডায়ানাকে আঁকতে রাজি হননি, পোপকে আঁকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, কিন্তু রানি এলিজাবেথের বিসদৃশ প্রতিকৃতি এঁকেছেন।


১৯৫০-৫১ সালে আঁকা 'গার্ল উইথ এ হোয়াইট ডগ'-এর এক স্তন বের করা হলুদ পোশাক পরা নারী তাঁরই প্রথম স্ত্রী কিটি কিংবা ক্যাথলিন,  বিখ্যাত ভাস্কর জ্যাকব এপস্টেইনের মেয়ে। এরপর প্রায় ৬০ বছর ধরে লুসিয়ান মানুষই এঁকে গেছেন, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগই নারী। আমি মানুষ আঁকি_মোটাদাগে এটাই তাঁর ভাষ্য; পরক্ষণে বলেন, মানুষকে ঠিক যে রকম দেখায়, সে কারণে নয়, আমার কাছে যেভাবে ধরা দেয়, সে কারণে। লুসিয়ান তাঁর ছবি, বিষয়, মডেল, পরিবেশ_সব কিছু নিবিড়ভাবে দীর্ঘ সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন। ২০০৭ সালে সম্পন্ন করা একটি ন্যুড তাঁর ১৬ মাস সময় নিয়েছে, কেবল তুলি হাতে ছবিতে কাজ করেছেন ২৪০০ ঘণ্টা। মডেলের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে তাঁর সখ্য বিছানা পর্যন্ত গড়িয়েছে। 


অমৃতা ও ফৃদার নগ্নতা

১৯১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি অমৃতা শের-গিল জন্মগ্রহণ করেন হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে, তার পিতা উমরাও সিং শের-গিল মজীদিয়ায়, একজন শিখ উপাসক এবং সংস্কৃত ও ফার্সীর একজন পণ্ডিত এবং তার মাতা মারি আন্তোয়ানেট গটসমান, হাঙ্গেরীয়-ইহুদি অপেরা গায়ক এবং এক সমৃদ্ধ বুর্জোয়া পরিবার থেকে এসেছেন।  তার বাবা-মা প্রথমে ১৯১২ সালে পরিচিত হন, যখন মারি লাহোর পরিদর্শন করেন। তার মা মহারাজা রঞ্জিত সিংহের নাতনী রাজকুমারী বাম্বা সাদারল্যান্ডের সঙ্গী হিসেবে ভারতে আসেন।


অমৃতা শেরগিল।ঘুমন্ত সুন্দরী

শের-গিলের শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ইউরোপে। ১৯২১ সালে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে তার পরিবার উত্তর ভারতের শিমলায় স্থানান্তরিত হয়। সেখানেই আট বছর বয়সে ছবি আঁকায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হাতেখড়ি হয় তার। প্রথমে মেজর হুইটমার্শের কাছ থেকে, এবং পরবর্তীতে বিভেন প্যাটম্যানের কাছে নিয়মিত দীক্ষা নিতে থাকেন তিনি। শিশুকালে শের-গিল নিজেকে নাস্তিক দাবি করায় স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে। ষোল বছর বয়সে তিনি প্যারিসে চলে যান এবং শিল্পকলা নিয়ে আরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন।

এসময় পল সেজান, আমেডিও মোডেয়ানি, পল গগ্যাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তার বেশ কিছু ছবিতেই গগ্যাঁর রচনাশৈলীর ছাপ পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো 'সেল্ফ পোর্ট্রেট অ্যাজ আ তাহিতিয়ান'। এই আত্ম প্রতিকৃতিতে অমৃতাকে দেখা যায় একজন তাহিতিয়ান নারীর বেশে। অমৃতা তাঁর সাহসী সৃষ্টি দ্বারা সেসময় বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সেসময় নগ্ন ছবি খুব একটা প্রশংসিত ছিল না উপমহাদেশে আর সেটা যদি একজন নারী শিল্পী দ্বারা আঁকা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তো কথাই নেই! তবে এই প্রতিকূল অবস্থায়ও অমৃতা থেমে থাকেননি। তিনি তুলির আঁচড়ে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্ট ন্যুড পেইন্টিংগুলোর মধ্যে অনন্য এক সৃষ্টি 'স্লিপিং ওম্যান' (১৯৩৩)।


ফ্রিদা কাহলো ডি রিভেরা (স্পেনীয়: Frida Kahlo de Rivera, স্পেনীয় উচ্চারণ: [ˈfɾiða ˈkalo]; জুলাই ৬, ১৯০৭ – জুলাই ১৩, ১৯৫৪), জন্ম নাম: মাগদালেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ই ক্যালদেরোন, ছিলেন একজন মেক্সিকান চিত্রশিল্পী, যিনি তার আত্মোন্মিলনি ঘরণার চিত্রের জন্য আলোচিত। কাহলোর জীবন অতিবাহিত হয় মেক্সিকো শহরে, তার বাড়িতে, যেটি "লা কাসা আজুল" বা নীল ঘর নামে পরিচিত। তার কাজ আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত মেক্সিকোর জাতীয় ও দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতীকস্বরূপ, এবং নারীবাদীদের কাছে তার চিত্রকর্ম খ্যাতি পেয়েছে নারীর অভিজ্ঞতা ও রুপের আপোষহীন প্রকাশের জন্য।


ফৃদা কাহলো।অরণ্যে দুই নারী।

ফ্রিদা কাহলোর কাজে মেক্সিকোর সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বেশ গুরুত্ব পেয়েছে, যার কারণে তার চিত্রকর্ম কখনো কখনো অর্বাচীন শিল্প বা লোকশিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার কাজকে পরাবাস্তবের অন্তর্গতও করা হয়েছে, এবং ১৯৩৮ সালে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের প্রধান আঁদ্রে ব্রেটন, ফ্রিদার কাজকে "রিবন অ্যারাউন্ড এ বোম্ব" আখ্যা দিয়েছিলেন। ফ্রিদা, ব্রেটন এর দেওয়া পরাবাস্তববাদী আখ্যা অস্বীকার করেন, কেননা তার মতে, তার চিত্রকর্মে পরাবাস্তব এর চেয়ে তার বাস্তব অবস্থার প্রতিফলনই প্রবল।


ভূপেন খাখারের আপন ভুবন

দক্ষিণ এশিয়ায় অসংখ্য আশ্চর্যজনক শিল্পী ও চিত্রকরের আবির্ভাব হয়েছে কিন্তু ভূপেন খাখরের মতো শিল্পী দুর্লভ। ১০মার্চ, ১৯৩৪ ভারতের বোম্বেতে জন্মগ্রহণ করেন। স্ব-শিক্ষিত চিত্রশিল্পী খাকার শিল্পজীবন অপেক্ষাকৃত দেরিতে শুরু করেছিলেন। মূলত,  চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (CA) হওয়ার পথে ছিলেন। তিনি তাঁর পরিবারের প্রথম ব্যক্তি যিনি বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। যদিও তার কাছে শিল্পকর্ম একটি শখের বিষয় ছিল, কিন্তু তার উচ্চাভিলাষ সব সময় নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছে।


অবসর সময়ে, খাখর সাহিত্য, ভিজ্যুয়াল আর্ট এবং হিন্দু পুরাণ পড়াশোনা করতেন। ১৯৫৮ সালে খাখার গুজরাটি কবি এবং চিত্রশিল্পী, গুলাম মোহাম্মদ শেখের সাথে দেখা করেছিলেন, যা তাকে শিল্পের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল। শেখ খখারকে বরোদার চারুকলা অনুষদে যোগদানের আহ্বান জানান, এটি ঐতিহ্যবাহী স্কুলের বিকল্প, যা সমসাময়িক শিল্পকে এগিয়ে নিয়েছে। এ সময়  জলরঙ,  তেলরঙ্গে তিনি সাহসী, চমকপ্রদ সব কাজ উপস্থাপন করেন। খাখারের বেশিরভাগ কাজই সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপ তুলে ধরে। মানুষের ভঙ্গুরতা এবং মহানগরের যাপন ঘিরে তার কাজগুলো আবর্তিত।


ব্রিটিশ শিল্পী স্যার হাওয়ার্ড হজকিনের সাথে তার মিথস্ক্রিয়া বিশেষভাবে প্রভাবশালী ছিল। সত্তরের দশকে, যুক্তরাজ্যে হজকিনের সাথে তার কর্মজীবনের সময়, খাখার সমকামিতার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং স্থানীয় ট্যাবুর সাথে সরাসরি পরিচিত হন। তার নিজের পারিবারিক পটভূমি তার নিজের যৌনতার ব্যাপের তাকে অপরাধমনস্ক করে তুলেছিল। ১৯৮০সালে মায়ের মৃত্যুর পরে খাখার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি সমকামী। এটি তার কাজের একটি ফোকাল বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। এটি যুগান্তকারী, কারণ  খাখারই প্রথম ভারতীয় শিল্পী যিনি তার কাজের মাধ্যমে নিজের যৌনতা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর চিত্রকর্মগুলি কেবল কল্পিত এবং প্রাণবন্ত ছিল না, সৃজনশীল হিসাবে তাঁর অবস্থান ছিল বিপ্লবী। ভারতীয় সংস্কৃতির অন্বেষণ ছাড়াও, তার চিত্রকর্মগুলি পরিচয়, শূন্যতা এবং স্বাধীনতার থিমগুলির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল।


You Can't Please All!Bhupen Khakhar.

খাখারের  চিত্রকলা সামগ্রিকভাবে জীবনের বৈপরীত্যের প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা সবাই আমাদের নিজেদের গল্প বলতে চাইছি। কিন্তু সামাজিক শর্তের যোয়ালে তা বলতে পারছি না। শিল্পী তার সমকামীতা সম্পর্কে জানতেন ছোটবেলা থেকে, ব্রিটেনে তার অভিজ্ঞতা সমকামিতা সম্পর্কে তার বোঝাপড়া বদলে দিয়েছিল। তার অন্যতম একটি ক্যানভাসে, একটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজন নগ্ন ব্যক্তি নীচের দৃশ্যগুলি দেখছে। মনে হতে পারে, এটি গ্রীক গল্পকার ঈসপের কাল্পনিক গল্প। নৈতিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোককথার মধ্যে প্রাকৃতিক ভালো, খারাপে গল্প। কল্পকাহিনীর পিছনে বার্তাটি হল যে প্রত্যেকের একটি মতামত আছে এবং সকলকে সন্তুষ্ট করা অসম্ভব, ইউ কান্ট প্লিজ অল।.ইতিহাসবিদ, মিশেল স্ট্যান্ডলি, চতুরভাবে বলেছেন যে চিত্রকর্মটি "সমাজের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা এবং অংশগ্রহণ করার ইচ্ছার একটি সূক্ষ্ম মূর্ত প্রতীক।"


By Bhupen Khakhar
খাখার যেভাবে উজ্জ্বল ব্লক রং ব্যবহার করে তা সমঝদারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছায়াকে এমনভাবে ব্যবহার করতেন যা চিন্তা-উদ্দীপক অন্ধকার তৈরি করে। ভূপেন খাখার তাঁর শিল্পে  সবথেকে বিশিষ্ট ভাবে যা তুলে ধ্রএছিলেন তা হল নির্জনতার ধারণা। মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবন চিত্রিত করার পাশাপাশি,কমলা, লাল এবং বাদামী রঙের ব্যবহার সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ক্যানভা্সে ভারতের সমৃদ্ধ উষ্ণতাকে তুলে ধরতো। ভক্তদের অনুমান প্রতিটি প্যানেল খাখারের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া হয়েছে।


২০০৩সালে  সালে একটি সাক্ষাত্কারের সময় খাক্কার স্পষ্টভাবে এ সম্পর্কে বলেন, সৃজনশীল মোগল কিভাবে ভারতীয় সমাজকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং ব্রিটিশ রাজ পরে  কীভাবে তা বদলে দিয়েছিল। তিনি বলেন, “ ব্রিটিশ রাজ এবং ভিক্টোরিয়ান উত্তরাধিকার আমাদের ভীরু করে তুলেছে। আমাদের ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে, ব্রিটিশরা আমাদের সমাজের শরীর এবং যৌনতার ঐতিহ্যগত  খোলামেলা মনোভাবের জন্য আমাদের লজ্জিত করেছে। এটি এখন আমাদের ভন্ড জাতিতে পরিণত করেছে।"


দ্রষ্টব্য যে বারোদার অনেক ছাত্রছাত্রী খাখারের আঙ্গিকে প্রভাবিত হলেও ক্যানভাসে তার যৌন তীব্রতা ধারণ করতে পারে নাই। বারোদা ফেরত বাংলাদেশের কার্টুনিস্ট ও চারুকলার শিক্ষক শিশির ভট্যাচার্যের আকাআকিতে খাখারের প্রভাব সুষ্পষ্ট, তবে খাখার যেভাবে তার কাজে যৌনতার সঞ্চার করে চরিত্র ও দৃশ্যপট জান্তব করে তোলেন, তা শিশিরের কাজে নেই। 


দক্ষিণ এশীয়রা তাদের যৌনতা এবং এর সাথে সংযুক্ত সাংস্কৃতিক চাপের সাথে লড়াই করে, খাখারের চিত্রকর্মগুলি সে চাপের বিরুদ্ধে একটি ক্ষমতায়নের সারাংশ প্রদান করে। ১৯৮৪ সালে,'পদ্মশ্রী', শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ভারত সরকারের পুরস্কার প্রদান করা হয়।১৯৮৬ সালে এশিয়ান কাউন্সিলের স্টার ফাউন্ডেশন ফেলোশিপও জিতেছিলেন এবং ২০০০ সালে 'প্রিন্স ক্লজ অ্যাওয়ার্ড'এ সম্মানিত হন।


দীপা হকের দ্বিধা**  

অকাল প্রয়াত শিল্পী দীপা হকদের১/৭/১৯৫৩, ৪/০১/১৯৯৯) ব্যাচ যখন ১৯৭০সালে শেষ দিকে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়াধীন, তার কয়েক মাসের ভেতর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। দীপাদের ক্লাস শুরু হয় ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম ব্যাচ। ১৯৭৪এ বন্ধুদের সাথে ঢাকা পেইন্টার্স প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দীপা ন্যুড বা নগ্নতা নিয়ে দ্বিধার ভেতরে পড়েছিলেন, তার সাথে নিজের মত করে বোঝাপড়া করে একটি মীমাংসায় পৌছাতে চেয়েছিলেন, তা তার কাজের চেয়েও বেশি বোঝা যায়, নিজের যাত্রাপথ নিয়ে তার লেখায়।


দীপা যখন ভারতের বারোদায় পড়াশোনা করছেন, তখন সেখানে চিত্রকলার শিক্ষক জি, এম, শেখ ও ভুপেন খাকার। দুজনের ভেতর খাকারের কাজ আমার প্রিয়। দীপা ওর লেখায় জানাচ্ছে যে এই দুজন তখন ন্যারেটিভ পেইন্টিংএ জোয়ার এনেছে। দীপা যে জিনিসটা খুলে বলেন নি, তা হলো খাকার কি ধরনের ন্যারেটিভ পেইন্টিং করতেন। আবার তার ঠিক আগের প্যারাতে লুসিয়ান ফ্রয়েড, বি কিতাইয়ের নামোল্লেখ করে যা লিখেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে দীপা নগ্নতা নিয়ে বলছেন।


দীপা হক 

দীপা যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর দোরগোড়ায়, তখন ওর দুশো কাজ নিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে একটি প্রদর্শনী হয়, সে উপলক্ষে একটি বই প্রকাশ হয়। বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেখাটি লিখেছিল দীপা নিজে। এক জায়গাতে দীপা লিখেছে  ‘’ড্রয়িং এর ভেতরেই আমাকে খুঁজে পেয়েছি আমি। এসব ড্রয়িংএ কিছু ন্যুড ছিল। তা দেখে কাউকে কাউকে ভ্রু কোঁচকাতে দেখেছি মনে পড়ে। আমাদের সমাজে নগ্ন মানব দেহের যথাযথ প্রতিকৃতি অঙ্কনে বিধিনিষেধ আছে। এই বিধিনিষেধ এড়িয়ে যেতে শিল্পীদের স্টাইলাইজেশানের শরণাপন্ন হতে হয়। না হলেই ভালো হতো। শ্রষ্ঠার সকল সৃষ্টির মধ্যে মানব দেহকে আমি সবচেয়ে বেশী নান্দনিক গুণসম্পন্ন বলে বিশ্বাস করি। সমসাময়িক যে দুজন শিল্পীর মানব দেহের উপস্থাপনা আমাকে মুগ্ধ করেছে তারা হলেন আর, বি, কিতাই আর লুসিয়ান ফ্রয়েড।’’


খাকারের বেশির ভাগ আকাআকি হচ্ছে আত্মজৈবনিক। জি, এম, শেখের আরেক পরিচয় হচ্ছে কবি এবং খাকারের ভক্ত। বারোদাতে চিত্রকলা বিভাগের ভার পাবার পর জি, এম, শেখ খাকারকে শিক্ষকতার নিমন্ত্রণ জানান। খাকারের মাপ কেবল একজন খাকারই ছুতে পারে। আশির দশকে লন্ডন, বার্লিন, আমস্টারডাম, টোকিওতে গ্যালারি মালিকেরা খাকারের কাজ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। শিল্পের অনুশীলনে খাকার কিন্তু পুরোপুরি স্বশিক্ষিত। খুব কাছে গিয়েও দীপা খাকার, জি, এম, শেখের কাছাকাছি যেতে পারলেন না। এই আক্ষেপটুকু দীপা যেভাবে তার লেখাতে উজাড় করেছে, তা আমাদের পিছুটানগুলোর টেস্টামেন্ট হয়ে থাকবে।


নগ্নতার কোনো উপসংহার নেই

জীব জন্তুর ক্ষেত্রে আমরা বলি না, নগ্ন জীব জন্তু।মানুষের ক্ষেত্রে আমরা ব্যাবহার করি নগ্নতা।আচরণের ক্ষেত্রে আমরা নগ্নতাকে ইতিবাচক, নেতিবাচক দু ভাবেই ব্যাবহার করি। কেউ যখন স্পষ্টকরে ম,এর কথা প্রকাশ করে, আমরা বলি, কোনো রাখঢাক ছাড়া বলছে।রাখঢাক তৈরি হয় অনেক ভাবে।আদপ, বেয়াদপ, হায়া, বেহায়া, লজ্জতা, নির্লজ্জতা, সেন্সর, আন-সেন্সর, বিধিনিষেধ, রিচ্যুয়াল, ধর্ম, অধর্ম অনেক ভাবে নগ্নতার পক্ষে এবং বিপক্ষে মতামত দেয়া হয়।শিল্পক্ষেত্রে অবয়ব বাঁ ফিগারের ধারাবাহিকতা তৈরি হয় আঙ্গিকের মাধ্যমে। ফ্রান্সের মাতিস, স্পেনের পিকাসো কাছাকাছি আঙ্গিকে এঁকেছে, আবার দুজনেই পল সেজানের আঙ্গিককে ভাংলেও সেজানকে তাদের সবার পিতা বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।


আবহাওয়ার সাথে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন ধরনের পোশাকের প্রচলন হলেও, আমরা এখন তার সাথে নৈতিকতা যোগ করেছি। বিশেষ করে নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে পুরো সমাজ, ব্যক্তিক ইচ্ছা, অনিচ্ছা থেকে  সামাজিক ইচ্ছাকে প্রধান দিয়ে আসছে। খাখারের ভাষ্যে আমরা জেনেছি, ভারতীয় খোলামেলা ঐতিহ্যের ওপর কিভাবে ভিক্টোরিও মূল্যবোধ লজ্জা ও অপরাধবোধ চাপিয়েছে। নগ্নতাকে দেখা হচ্ছে আদিবাসী প্রবণতা এবং শুধু যৌন উপস্থাপনা হিশেবে। ফলে নগ্নতা, আপাত নগ্নতার সামনে আমরা অস্বস্তিতে পড়ছি। চিকিৎসকের সামনে রোগ লক্ষণ নির্ণয়ে আমরা নগ্ন হই, কিন্তু একে অন্যের সামনে নগ্ন হতে সচেতন হয়ে পড়ি।একটা সময়ে এসে আমরা বুঝতে পারি আত্মা এবং যৌনতার কোনো সীমা সরহদ্দ ঙেই, সেখানে আমাদের প্রাণস্পন্দন যখন প্রেমোপোলব্ধিতে আসে, তখন আমরা খুবই নগ্ন এবং নির্ভার পালকের মত হালকা!


সঙ্কলণ ও সম্পাদনা

নাসরিন-জয়া হক



কৃতজ্ঞতা :

প্রয়াত অধ্যাপক কবির চৌধুরী, অন্তর্মুদ্রাবাদী বা ইম্প্রেশানিস্ট অংশ।

কথসাহিত্যিক আন্দালিব রাশদী লুসিয়ান ফ্রয়েড অংশ/ওয়াইকিপিডিয়া অনুবাদ।

কবি ও নাট্যকার চয়ন খায়রুল হাবিব, ভূপেন খাখার, দীপা হক অংশ।

লুবনা ইয়াসমিন, বিভিন্ন অংশ ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ।

শ্যামল দত্ত, বিভিন্ন  অংশ অনুবাদে সহায়তা।