ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, June 10, 2022

একটি মৃত্যু সংবাদ এবং তুলনামূলক কাব্য বিচার

।।আশরাফ রোকন।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।শৈবাল মাহমুদ।।

কবি আওলাদ হোসেন

চলে গেলেন কবি আওলাদ হোসেন। প্রকৃত এক কবির পথিকৃৎ। ময়মনসিংহে থাকাকালীন অনেকবার আওলাদ ভাইয়ের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিলো। চরম আড্ডাবাজ ছিলেন। তাঁকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের এপাড় ওপাড় অনেক অনেক গ্রামে, দরবারে, রওজায় মজমা দেয়ার স্মৃতি আছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কুঁড়েবাড়িতে তাঁর শেষ আবাস হয়েছিলো সেখানেও গিয়েছি কয়েকবার।
বলা যায়, আওলাদ ভাইয়ের খুব কাছে এসেও তাঁকে জানা হলো না। তবু যতোটুকু জানা হয়েছিলো সে টুকুর মূল্যও কম নয়, ভোগবাদী জীবনের পথকে ইগনোর করে বেছে নিয়েছিলেন সন্তের জীবন। তা না হলে প্রথম শ্রেণির একটা নিশ্চিত জীবন ছেড়ে কেউ এমন অনিশ্চিতের পথে নামে!
কথা বলা, চলাফেরা, আচার-আচরণে তিনি ছিলেন সহজিয়া ঘরানার মানুষ। কখনও তাঁর মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখি নি। প্রচুর পড়াশোনা করতেন। বিশ্বসাহিত্যের প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিলো। মনে পড়ে একবার 'বায়রন সমগ্র' দিয়েছিলাম তাঁকে ছয়মাস পরে ফেরতও দিয়েছিলেন। গানও গাইতেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে। শহরের ৪২/সি কলেজ রোড, খোকন ভাইয়ের বাসায় আমাদের বহুবার সঙ্গত হয়েছে। একজন পরিপূর্ণ কবিমানস ছিলেন তিনি। বিশুদ্ধ উচ্চারণে কী সুন্দর বাচনভঙ্গি ছিলো তাঁর।
অভিমানী ছিলেন। অভিমানে অভিমানে জীবনটাই পার করে দিলেন। কখনো শিল্পের বড়াই করতেন না। তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'বন্দীদেবতা'র প্রকাশক ছিলেন তসলিমা নাসরিন। জেলা তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন। এ প্রসঙ্গে কথা উঠলে তিনি নির্বিকার থাকতেন। যত্রতত্র নিজেকে হেয় করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিলো। 'দ্বিতীয় চিন্তা' সম্পাদক সর্বজনশ্রদ্ধেয়, প্রয়াত ইফফাত আরা-এঁর জীবদ্দশায় আওলাদ ভাইকে যতো সম্ভব সহযোগিতা দেয়ার নজির আছে। আজ আওলাদ ভাই নেই।ঘুরে ফিরে কতো কথাই মনে পড়ছে।

আশরাফ রোকন
৪জুন, ২০২২,
ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ

এক সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ


আশির দশকে কাজল শাহনেওয়াজের সাথে দেখা করতে প্রায়ই রিফাত চৌ ও আমি মকৃবিতে যেতাম। সেরকম একবার এক সন্ধ্যায় কাজল, রিফাত, আমি ময়মনসিংহ শহরে গেলে আওলাদ হোসেনের অফিস প্লাস বাসাতে হাজির হই। সেই একবারই। খুব সম্ভবত শুস্কমঞ্জরিতে উমধা অবস্থায় আমাদের বিশ্রাম বা হিসু দরকার পড়েছিল।

সে এক ভাঙ্গাচোরা, ভুতুড়ে, দেয়ালে বট গজানো, পোড়া ইটের বাড়ি। টিম টিমে ইলেকট্রিক আলোর অবস্থা হারিকেনের চেয়েও পাওয়ার কম, অন্ধকার তা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ভেতর ঠোট টেপা হাসি নিয়ে আওলাদ 'ক্ষুধিত পাষাণের' নায়ক ও অবাসাদগ্রস্থ সিরিয়াল কিলারের মাঝামাঝি একটা অবস্থায় বসে আছেন। দেখে মনে হয়েছিল, লোকটা ঠিক করতে পারছে না, কি করবে। পরে যখনই শহিদুল জহিরের বইয়ের মলাট দেখেছি বা সেসব বইয়ের পাঠকদের সামাজিক নেটওয়ার্কে দেখেছি, আমার না মনে পড়া আওলাদকে মনে পড়বে বলে মনে হয়েছে। এখনকার ভাঙ্গা চোয়াল ছবির সাথে সে সময়ের গাল ফোলা, হালকা চুলো তথ্য কর্তার মিলবে না।

কাজল, রিফাতেরা বলতো আওলাদ। কিছুদিন পরে কাজল জানিয়েছিলো চাকুরি ছেড়ে দিয়ে মকৃবির কাছে এক আস্তানায় ঠাই নিয়েছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে চলে গিয়েছিল সিলেটের কিশোয়ার ইবনে দিলওয়ার, জাপান না কি মার্কিন ফেরতা কুমিল্লার আজফার হোসেন, ঢাকার আহমেদ মুজিব, না লেখা কবিতাগুলো ভাবতে ভাবতে এরা নিজেরা কবিতা হয়ে গেছিলো। পরে কাজল, রিফাতের সাথে আমার হাজার বার দেখা হয়েছে, তবে আওলাদ আর আমাদের 'ভাঙ্গা লিরিক- ভাঙ্গা বয়ান-খোলামিলের' ম্যাপে ছিলো না।

আওলাদ হোসেনের সাথে সে সন্ধ্যাটা আমার একটু একটু মনে আছে। কথা বলছিলেন কম। রিফাত, কাজল, আমি শুষ্ক মঞ্জরিতে উমধা থাকলেও নিজেদের ভেতর প্রচুর কথা বলতাম। বুঝতে পারছিলাম, আমাদের তিন জনের কারো সাথে ওনার জমছে না। আবার তিন তরুণ কবি হাজির, ভ্যাবাচেকা আত্মতৃপ্তি বগলে রাখা টেনিস বল হয়ে শেভ না করা ফোলা গালে ঝকঝক করছিলো। মারেফতি কি কি একটু বলেছিলেন, কাজলের এখনকার ভাষার মত। আমি তখন ইউনিতে ফার্স্ট কি সেকেন্ড ইয়ার। সেশন জটে আটকানো তখনকার বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে গ্যাজেটেড অফিসারের সোনার হরিণ পেয়ে গেছেন আওলাদ, কিন্তু মন জুড়ে পালাই, পালাই। কাজল, রিফাত, আমার ভেতর কখনো কোনো প্রটোকলের বালাই নাই। মারেফতি হওয়া স্বত্বেও আওলাদ এই বন্ধুত্ব বুঝে উঠতে পারেন নাই। অস্বস্তি কাটাতে আমাদের নিয়ে গেলেন তসলিমা নাসরিনের বাসাতে।

মফস্বলি অন্ধকারে সেটা মনে হয় হেটেই গিয়েছিলাম। পথের এখানে সেখানে স্ট্রিট লাইটগুলো অন্ধকার আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। সেই টিমটিমে অন্ধকারে, যেই ওনাকে দেখেছিলো, চিনে নিয়ে স্যার, স্যার করছিলো। তসলিমাদের বাসাতে তসলিমা ও ওনার ছোটো বোন স্যার, স্যার না করলেও কেমন একটা নীরব, উচ্ছ্বসিত প্রটোকলমূলক অদৃশ্য করমর্দন করছিলেন ওনার সাথে। তসলিমার ছোটো বোন মনে আছে একটু বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে কি কি দেখাচ্ছে।

যে কোনো শহরের মধ্যবিত্তের বসার ঘরের মত সুন্দর করে সাজানো তসলিমাদের বৈঠকখানা।ওখানেও আমাদের জমছিলো না। ঢাবি ক্যাম্পাসে রুদ্রদা, আমাকে স্নেহ করলেও ওনার সাথে এবং অন্যান্য সম্পাদক কবিদের সাথে তসলিমাকে বহুবার দেখা সত্বেও তেমন পরিচয় ছিলো না। রিফাত, কাজলদের সাথে ওনার পরিচয় থাকলেও ওদের এন্টেনাতে উনি ছিলেন না।

সেই না জমা টিমটিমে রহস্য-বিহীন, সাঙ্কেতিক দূরত্ব-বোধক সন্ধ্যায় শোকেসের ওপর চোখে পড়লো তসলিমার কিছু বই। জানতে চাইলাম, 'একটা নিতে পারি'? উনি লিখে দিলেন, 'শুভেচ্ছা, শুভেচ্ছা ' দুই বার।বইটা হারিয়ে গেছে। তসলিমা নাসরিন হয়তো কোথাও আওলাদের চলে যাওয়া পড়ে ওনার প্রথম প্রকাশক হিশেবে ছোট বোনকে ফোনে কিছু বলবে কিম্বা বলবে না। পুরো ব্যাপারটা আসলে এলান পোর সেই অবসাদগ্রস্ত 'আশার হাউসের' মত। জীবনানন্দ যা অনুবাদের পর চলন্ত ট্রামের দিকে ধাবিত হয় নিজের যাত্রাপথের ইতি টানতে। ট্রামযাত্রীদের জন্য সেটা শুধু একটা বিরাম চিহ্ন!

চয়ন খায়রুল হাবিব
৮/০৬/২২
ফ্রান্স

তুলনামূলক কাব্যগুণ বিবেচনা, অবিবেচনার পরিসরে!

তসলিমা নাসরিন তারুণ্যে যার প্রথম কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন।

কে এই আওলাদ হোসেন?


তথ্য যা পেলাম, আওলাদ হোসেন, আশির দশকে ময়মনসিংহে বিসিএস তথ্য কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় চাকুরি ছেড়ে দিয়ে মুর্শিদি লাইনে চলে যান। 'জুলেখা সিরাপ মেটাভার্সের' সদস্য, আশরাফ রোকন ওনার সম্পর্কে লিখেছেন, 'চরম আড্ডাবাজ', 'সন্ত', 'বিশ্বসাহিত্যের সমঝদার', 'বিশুদ্ধ উচ্চারণের মানুষ'। চয়ন খায়রুল হাবিব জীবনে একবার একটি সন্ধ্যায় সাক্ষাতের সংক্ষিপ্ত বিবরণে লিখেছেন 'ক্ষুধিত পাষাণের নায়ক'। মনির ইউসুফ লিখেছেন, 'কবি ও দরবেশ'। একটা তথ্য পেলাম, আওলাদ হোসেনের প্রথম কবিতা গ্রন্থ 'বন্দী দেবতা'র প্রকাশক ছিলেন তসলিমা নাসরিন।

আড্ডাবাজি, সন্ত যাপন, দরবেশি, বিশ্বসাহিত্যের সমঝদারি, বিশুদ্ধ উচ্চারণ, নায়কোচিত ভঙ্গি কোনটা আসলে কাব্যগুণের তুল্যদন্ড নয়।কাব্যগুণে পরিচায়ক কবিতা। মৃত্যু খবর দিয়ে অনেকে চার পাঁশে লোকজন জড়ো করেন, কিন্তু এদেরকে জীবৎকালে একজনের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায় না। চয়ন খায়রুল মূলত রোকন আশরাফের দেয়া লেখাটি শেয়ার করতে গিয়ে একই সন্ধ্যাতে আওলাদ ওনাকে, রিফাত চৌ, কাজল শাহনেওয়াজকে তসলিমা নাসরিনের বাসাতে নিয়ে যাবার কথা উল্লেখ করেছেন। রোকন তার লেখাতে আরেকজন ইফফাত আরা আওলাদকে সহায়তা করবার কথা বলেছেন।মনির তার লেখাতে আওলাদকে দরবেশ বলে একজন কামাল চৌধুরীকে আক্রমণ করেছেন। এ লেখাগুলোর ভেতর চয়নের লেখাতে বোঝা যাচ্ছে, ওনাদের কাব্যিক ঈক্ষণের সাথে আওলাদের লেখার মিল ছিল না, চয়ন লিখেছেন, 'পরে কাজল, রিফাতের সাথে আমার হাজার বার দেখা হয়েছে, তবে আওলাদ আর আমাদের 'ভাঙ্গা লিরিক- ভাঙ্গা বয়ান-খোলামিলের' ম্যাপে ছিলো না।'

রিফাতের কবিতা আসলে খুবই কাচা। প্রচুর কবিতার বই আছে ওনার। রোকেয়া প্রাচী, ইরেশ যাকের থেকে প্রচুর শুভানুধ্যায়ী আছে রিফাতের।আওলাদ চাকুরি ছেড়ে মুর্শিদি নিয়েছিলেন। রিফাত কখনো চাকুরি, বাকুরি করেন নাই। কিন্তু রিফাতের একটা পেশা ছিলো এবং এখনো আছে।অভিনয়ের পাশাপাশি, ঢাকার সব মহল্লার ড্রাগ ডিলারেরা রিফাতকে চেনে। গত ৩০ বছরে রিফাত সেবনের পাশাপাশি বেশুমার ছেলে, মেয়েকে সফট ড্রাগ, হার্ড ড্রাগ ধরিয়েছে। বলা যায়, এটা তার অঘোষিত পেশা। বাংলাদেশে ড্রাগ সাম্রাজ্যটি চিন্তা করুন, আর এ পেশা থেকে গড ফাদার পর্যায় থেকে মাঠেঘাটে স্কাউটের আয় চিন্তা করুন। পাশাপাশি রিফাত মাঠ, ঘাটের অভিজ্ঞতা থেকে ভূয়োদর্শীতায় ওস্তাদ। ফেসবুক অনুসরণের তোড় থেকে বোঝা যায় মৃত্যুর আগে উনিও দরবেশে পরিণত হয়েছেন। সেখানে, যা বোঝা যাচ্ছে আওলাদ কোনোরকম আয়ের সাথে নিজেকে জড়িত রাখেন নি। ভাগ্যিস ইফফাত আরারা ছিলেন। এখানে ভূয়োদর্শী কবি, গায়েন কফিল আহমেদের কথাও মনে পড়ছে। ভূয়োদর্শন আর কাব্যগুণও আসলে এক জিনিস নয়। বাংলাদেশে এরকম বিবাগি অনেকের পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার থাকে। সেটা দোষের কিছু না।

কাজল শাহনেওয়াজ ও চয়ন খায়রুল হাবিবকে ঈক্ষণ, বীক্ষণে বলা যায় সম্পূরক। দুজনে আধ্যাত্মের জায়গাটিকে এলিয়েনেশান ও কল্পনার স্পেসে ব্যাবহার করেন। কাজল করেন মিনিমালিস্ট জায়গা থেকে, চয়ন করেন ইলাবোরেটিভ জায়গা থেকে। এটা তুলনামূলক আলোচনা। একজন আওলাদ যদি আধ্যাত্ম, এলিয়েনেশান/বিযুক্তি, কল্পনার যায়গা থেকে লেখালেখি করেন, তা নিয়ে চয়ন, কাজলের আগ্রহী হবার কথা। এদের দুজনেই অর্থোডক্স নন। তাহলে কোথায় এদের 'ভাঙ্গা লিরিক- ভাঙ্গা বয়ান-খোলামিলের' ম্যাপে' আওলাদের কবিতা আসতে পারে নি?

আমি নিজে আওলাদের কবিতা পড়িনি। তবে আওলাদের প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে চয়ন বলছেন, কিশোয়ার ইবনে দিলওয়ার, আজফার হোসেন, আহমেদ মুজিব এরকম একটি জায়গাতে চলে গিয়েছিল। কিশোয়ার, আজফার, আহমেদ মুজিবের কবিতা আমি এখানে সেখানে পড়েছি।কিশোয়ার, আজফার সরাসরি স্পিরিচুয়ালিস্ট হলেও, মুজিব সরাসরি স্পিরিচুয়ালিস্ট নন, তবে রোমান্টিক এবস্ট্রাকশানিস্ট স্কুলের অনুশিলক হিশেবে ঘুরপথে স্পিরিচুয়ালিস্ট। এক্ষেত্রে ফর্মের দিক থেকে কাজল মিনিমালিস্ট এবং চয়ন ইলাবোরেটিভ হলেও এরা স্পিরিচুয়ালিস্ট, এবস্ট্রাকশানিস্ট এবং রোমান্টিক স্কুলের নন। কাজল, চয়ন আগাপাশতোলা নন কনফর্মিস্ট তাদের অনুশীলনে। এদের দুজনের কাছে ফর্মও গুরত্বপূর্ন নয়। তবে ছোট ফর্মে হোক, ডিটেইলসে হোক এ দুজন চিন্তাকে শেষ করেন, কল্পনার অবকাশ দেবার পরও। মেটাফিজিকাল জায়গাতে দুজনের স্কুলে দাদাবাদ, আধ্যাত্মবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, পরাবাস্তবতা, ইম্প্রেশনিজম, যাদু বাস্তবতা, চূড়ান্ত বাস্তবতা, অধি বাস্তবতা সব বাদানুবাদ আসতে পারে, আসেও, কিন্তু দুজন শেষ অবধি সাহিত্যের দৃষ্টিকোণকে জেতাবেন, সাহিত্যকে বাহন করে আর কোনো স্লোগান বা স্পিরিচুয়ালিজমের জিন্দাবাদ করবেন না। এখানেই স্পষ্ট এ দুজন পরস্পরের রিভিউ করলেও কেনো উল্লেখিত অন্যদের রিভিউ করেন নি।

এবার বাকি থাকছে, তসলিমা নাসরিন প্রকাশিত আওলাদ হোসেনের প্রথম কবিতা গ্রন্থের প্রসঙ্গ। প্রসঙ্গটি আগের প্যারাতে খোলাসা হয়ে যাবার কথা।গদ্য, পদ্য সব মিলিয়ে তসলিমা কি রোমান্টিক স্কুলের একনিষ্ঠ পূজারি নন? রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ কবিতাও রোমান্টিক স্কুলের সম্প্রসারণ।চয়ন, কাজল, শামসেত তাবরেজী সহ আশির দশকে যারা বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়েছে, তাদের অর্জন মূলত ভাষাগত, ছন্দগত এবং স্কুলগত। কে জনপ্রিয় হয়েছে, কে বিতর্কিত হয়েছে, কার অনুসারী বেশী এসব ছাড়িয়ে যদি আমরা ধ্রুপদ সময় থেকে এখনকার দুই বাংলার কবিতা দেখি, তাহলে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের আশির কবিতা নান্দনিকতাকে বিমূর্ততা, পরোক্ষতা থেকে বের করে এনে, প্রতীককে সহজ করার পাশাপাশি প্রতীকের মাত্রিকতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা আটপৌরে ঘরানাতে রহস্যের বহুসচলতা সঞ্চার করেছে। এরা ভাষার যত্ন নিয়েছে, ভাষাকে খুলে দিয়েছে অক্ষরবৃত্তের দাবার চাল থেকে, গদ্যছন্দের যথেচ্ছাচারিতা থেকে।

তসলিমা শুরু করেছিলেন আওলাদের কবিতার বই প্রকাশ করে। বিপুল বিশ্বের, তুমুল যজ্ঞগুলোর পর, সব কিছুতে মাথা ঘামানোর পর, রুদ্রকে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ব্যায় করবার পর, বাংলা ভাষার প্রতি ওনার নিজের ভাষাগত নারীবাদী ভূমাতে যে রোমান্টিক স্কুলের প্রভাব আছে সে কথা বলবার অবকাশ হবে হয়তো একদিন। আবার ওনার জায়গাটি কারা ছাড়িয়ে গিয়েছে তাদের কথাও হয়তো বলবেন একদিন।

আমাদের কাব্য বিচারের জায়গাটি ঘোলা হয়েছে অনেক ভাবে। রিফাত চৌধুরীর অভিনয় কেরিয়ার গড়ে উঠেছে মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর কাজ ঘিরে, যিনি এবং যার সাঙ্গপাঙ্গ ভাষার প্রমিত চলিষ্ণুতাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাহত করেছেন জনতার ভাষার নামে, যখন জনতা ন্যুনতমো সহায়তায় তাদের ভাষা, সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।অনলাইনে, অফলাইনে ফারুকীর সফলতা দেখে অনেকে মনে করতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ প্রমিত চলিষ্ণুতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সবাই হৈছে, খাইছে ভাবে লিখতে চাচ্ছে। কাজল শাহনেওয়াজের একের পর এক এধরনের মিশেল ভাষাতে পোস্ট দেখেও মনে হতে পারে ফারুকীদের ভাষা প্রতিক্রিয়াশীলতার গ্রহণযোগ্য মঞ্চ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখনো হুমায়ুন আহমেদের ইর্শনিয় বিক্রি দেখে বোঝা যায়, জনতা অপ্রমিত, মিশ্র ভাষা নিতে চাচ্ছে না, বরং নিজেদের মুখের ভাষাকে পরিশীলিত করতে চাচ্ছে। তসলিমা নিজের নারীবাদী জায়গাতে সংহত থেকে, বাংলাদেশের উইমেন চ্যাপ্টারের দিকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, যাদের প্রমিত ফারুকী হচ্ছেন ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ মাহমুদ। ইনি এদের কবি, কলামিস্ট, এক্টভিস্ট। এই রৈখিকতার দাঁড়িয়ে আছে মূলত কে কি খাবে তার ওপর, যার ফলে রাজনীতির দুদিকে হলেও ফারুকী, ইমতিয়াজ যার যার ভাষায় মূলত একই ধরনের কথা বলেন, দুজনেই কারো কাছে বিবেক, কারো কাছে জাকির নায়েক। এই রৈখিক কচুরিপানার নিচে কোনো মাছই বাচার কথা নয়। বাংলা ভাষার শক্তি আছে বলতে হবে, কচুরিপানা ছড়াবার আগে চয়ন, কাজল, তাবরেজীদের স্যালমন, ইলিশগুলো এখনো ভাষার মিঠে পানিতে ডিম ছেড়ে খোলা সমুদ্রের দিকে ফিরে যেতে চাইছে!

আওলাদ হোসেন মারা গেছেন। তসলিমা নাসরিন নির্বাসিত। এখানে নৈর্ব্যাক্তিকতার কোনো অবকাশ নেই। আত্ম নির্বাসনে গিয়ে শহীদ কাদরী লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছিলেন, প্রবাস জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন সাক্ষাতকার, আড্ডাবাজি, আর অনুষ্ঠানের মঞ্চে। মেরুকরণগুলো গোলমেলে হলেও তসলিমা লেখালেখিতেই আছেন। মৃত্যু সংবাদের চেয়ে আমাদের বেশি দরকার জীবন্ত চর্চার খবরগুলো। পরানুভূতি জায়গা থেকে আমরা জানতে পারছি, বিশ্ব কোনো ছোট জায়গা নয়। বাংলাদেশ তার ভাষাকে যোগ্যভাবে এই বড় বিশ্বে ছড়িয়ে দেবে কি না, সে দায়িত্ব আমাদের সবার। তাতে আঞ্চলিক সঙ্কীর্ণতার অবকাশ নেই আর।

শৈবাল মাহমুদ
৯জুন, ২০২২
যুক্তরাজ্য

সম্পাদনা : নাসরিন-জয়া হক