।।সিরাজাম মুনীর শ্রাবন।।আলিমুর রাজি রানা।।
চা বাগানে কর্মরত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবন অন্যান্য বাংলাদেশিদের চেয়ে আলাদা। মূলগত দিক থেকে তারা বাংলাদেশি নয়, চা বাগানের বাইরে তাদের কোনো জায়গা জমি নেই, চা বাগানের বাইরে তাদের কোনো আত্মীয় স্বজন নেই।
শত শত বছর আগে ইংরেজ উপনিবেশিক আমলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে তাদেরকে চা বাগানের কাজের জন্য আনা হয়েছিল। দিন রাত পরিশ্রমের বিনিময়ে তাদেরকে দেওয়া হতো খাবার, আর নামে মাত্র অতি-অল্প পারিশ্রমিক। তারাও এসেছে, এসব কাজ করেছে, কারণ তখন ভীষণ অর্থকষ্ট ও খাদ্য কষ্ট ছিল তাদের। নিজ ভূম ছেড়েই হোক আর হাজার মাইল দূরেই হোক আর আত্মীয় স্বজন ছেড়েই হোক, আগে পেটের যন্ত্রণা সামাল দিতে হবে।দিনে দিনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। দূর হয়েছে বাইরের দুনিয়ার ক্ষুধার কষ্ট। বেড়েছে কর্মসংস্থান। কম হোক বেশি হোক খাটতে জানলে একজন মানুষের উপার্জন হয়ই কোনো না কোনোভাবে। সময়ে সময়ে সারা ভারত উপমহাদেশের পরিবর্তন এলেও পরিবর্তন আসেনি চা বাগানের ভেতরের শ্রমিকদের। তারা চাইলেও চা বাগানের বাইরে যেতে পারবে না কারণ এর বাইরে তাদের কোনো জমি নেই। কোনো আত্মীয়ও নেই যে তাদের আশ্রয় কিংবা সাহায্য করবে। কারণ তারা তো এ এলাকার মানুষ নয়, তাদের পূর্বপুরুষ তো এলাকার মানুষ নয়।
শৃঙ্খল ভেঙে যে হাজার মাইল দূরে নিজে রাজ্যে ফিরে যাবে সে উপায়ও আর নেই। এত বছর পর তাদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই সেখানে। বাগানের বাইরে যে কিছু একটা করবে এ অবস্থাও নেই। কিছু একটা করতে গেলে তো টাকার দরকার, কিন্তু তাদের উপার্জন এত কম যে নিজেরা বেঁচে থাকতেই কষ্ট হয়। এই মনে করুন সারাদিন কাজ করলে মজুরি হয় ৮৫ টাকা। একমাস কাজ করলে ৩ হাজার টাকাও হয় না।
কিন্তু যত যা-ই হোক, জীবন থেমে থাকে না। আপনার কাছে অঢেল অর্থ থাকলে আপনার সমাজের অন্যান্য মানুষেরও অঢেল অর্থ থাকলে আপনার জীবনধারণ আর আপনার সমাজের সিস্টেম একরকম হবে। অর্থ কম থাকলে অন্যরকম হবে। অর্থ না থাকলেও কোনো না কোনোরকম হবে। সমাজ ও জীবন তার প্রয়োজন অনুসারেই নিজেকে সাজিয়ে নেয়। চা বাগানের ভেতরেও হয়েছে তা-ই।
তাদের জীবন থেমে নেই। সেখানে তাদের মতো করে ধারা গড়ে উঠেছে। তাদেরও বিয়ে হয়, তাদেরও যৌনতার আবেদন সমাজ ছাড়িয়ে চলে যায়। তাদেরও সমাজ আছে, তাদের সমাজও ভুল করা মানুষদের একসময় গ্রহণ করে নেয়। আবার তাদেরও রীতি-সংস্কৃতি আছে, আবার তাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে।
যেমন তাদের রীতি অনুসারে আয়োজন করে বিয়ে করতে হয়। কিন্তু এই আয়োজন করার অর্থ নেই ছেলে কিংবা মেয়ের কাছে। তাই তারা পালিয়ে যায় এবং কিছুদিন পরে ফিরে এসে ঘর তোলে বসবাস শুরু করে। খুব সহজ ভাষায় এ জিনিসটার নাম লিভ টুগেদার। বাংলার সমাজে রি রি পড়ে যেত, কিন্তু সেখানে সেটা স্বাভাবিক। এমন না যে তারা সেটা গ্রহণ করে, কিন্তু পরিস্থিতি মেনে না নিয়েও উপায় নেই। বাংলার স্বাভাবিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কারণে বাংলার প্রচলিত সামাজিক সংস্কৃতির প্রভাব থেকে তারা মুক্ত।
এদের পাশাপাশি আরো এক সমাজ আছে, এরা চা বাগানের মালিক, বড় কর্তা ও সম্মানিত অতিথি। পুরো চা বাগানের দেখভালের জন্য কিছু শিক্ষিত কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। চা শ্রমিকদের কাছে যারা দেবতার সমান। তাদের সেবা শুশ্রূষা ও সম্মানের জন্য শ্রমিকদের আন্তরিকতার অন্ত নেই। তরুণ কোনো ছেলে জয়েন করলে তার একটু দেখা পাওয়ার জন্য, তার সাথে একটু কথা বলার জন্য, একটু সময় অন্তরঙ্গে কাটানোর জন্য প্রতিযোগিতার অন্ত থাকে না মেয়েদের মাঝে। বাংলার স্বাভাবিক সমাজে কোনো মেয়েই তার বান্ধবীদের কাছে গিয়ে বলবে না সে তার বড় অফিসারের সাথে অভিসারে গিয়েছিল। কিন্তু চা বাগানে এটা খুব গৌরবের বিষয়। অহংকার করে প্রচার করে এরকম খবর। শত শত বছর ধরে বিচ্ছিন্ন সে সমাজে এগুলোই এখন স্বাভাবিক বাস্তবতা।
একজন সুশীল হিসেবে যে জিনিস আপনি এই সমাজে বাস্তবায়ন করতে চাইছেন, সেটা শত বছর আগেই নিজ গতিতে বাস্তবায়িত হয়ে আছে চা বাগানের পরোক্ষ কৃতদাসদের সমাজে।
এরকম হাজারো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ দেওয়া যাবে যা তাদেরকে আলাদা করেছে বাইরের জগত থেকে। বাইরের মানুষেরা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন বলে তাদের ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির কথাগুলো উঠে আসে না কারো কলমে। দেখা যায় না তেমন কোনো ভিডিও। পত্রিকায় কখনো তাদের খবর পাওয়া যায় না, টেলিভিশনে তাদের কোনো ঘটনার কথা শোনা যায় না। হয় না তাদের নিয়ে তথ্যবহুল কোনো বই।
তবে তার মাঝেও কেউ কেউ কিছু করার চেষ্টা করেন। এমনই একটি প্রচেষ্টা হচ্ছে মোরশেদ আলম হীরার এই বইটি। লেখক তার চাকরিজীবনের শুরুতে জেমস ফিনলে টি এস্টেটে কাজ করেছিলেন। ঘুরেছিলেন বাগানে বাগানে। কাছ থেকে দেখেছিলেন চা শ্রমিকদের জীবন। অনুধাবন করেছিলেন চা বাগানের সমাজ ও বাস্তবতা। সে বিষয়গুলো নিয়ে তিনি একটু একটু করে স্মৃতিচারণা করেছেন সময়ে সময়ে। সেসব স্মৃতিচারণার গ্রন্থিত রূপ হলো এই বই- 'চা বাগানের বিচিত্র জীবন'।
খুব সুন্দর উনার ভাষা। তরতর করে পড়ে ফেলা যায় একেকটি অধ্যায়। পড়ে মজা পাওয়া যায়। তবে বইটা চা বাগানের জীবন, সমাজ ও সিস্টেম নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই নয়। চা বাগান নিয়ে সে অর্থে গোছানো ও তথ্যবহুল নয়। আসলে এটা মূলত লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা ও অভিজ্ঞতার বই। অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকথার ফাঁকে ফাঁকে চা বাগানের নানা বিষয় উ��ে এসেছে।
তবে এ বই পড়ে মনে হয়েছে, লেখক যদি চান এবং চেষ্টা করেন তাহলে চা শ্রমিকদের নিয়ে খুব সুন্দর, গোছানো ও তথ্যবহুল করে একটি বই তিনি লিখতে পারবেন। যে বই বাংলা ভাষায় এবং ইংরেজি ভাষায় থাকা খুবই জরুরি। এতদিন হয়ে গেল শত বছর পেরিয়ে গেল কিন্তু তাদের নিয়ে সে অর্থে ইনডেপথ কোনো বই নেই তা কীভাবে হয়? এই রিভিউয়ের মাধ্যমে লেখকের কাছে সেই আবেদন রইলো। ধন্যবাদ লেখককে চা বাগান নিয়ে বই লেখার জন্য।
চা বাগান ও চা শ্রমিকদের সম্পর্কে যারা আগ্রহী, তারা অবশ্যই এই বই পড়ে দেখবেন।
তাদের জীবন থেমে নেই। সেখানে তাদের মতো করে ধারা গড়ে উঠেছে। তাদেরও বিয়ে হয়, তাদেরও যৌনতার আবেদন সমাজ ছাড়িয়ে চলে যায়। তাদেরও সমাজ আছে, তাদের সমাজও ভুল করা মানুষদের একসময় গ্রহণ করে নেয়। আবার তাদেরও রীতি-সংস্কৃতি আছে, আবার তাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে।
যেমন তাদের রীতি অনুসারে আয়োজন করে বিয়ে করতে হয়। কিন্তু এই আয়োজন করার অর্থ নেই ছেলে কিংবা মেয়ের কাছে। তাই তারা পালিয়ে যায় এবং কিছুদিন পরে ফিরে এসে ঘর তোলে বসবাস শুরু করে। খুব সহজ ভাষায় এ জিনিসটার নাম লিভ টুগেদার। বাংলার সমাজে রি রি পড়ে যেত, কিন্তু সেখানে সেটা স্বাভাবিক। এমন না যে তারা সেটা গ্রহণ করে, কিন্তু পরিস্থিতি মেনে না নিয়েও উপায় নেই। বাংলার স্বাভাবিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কারণে বাংলার প্রচলিত সামাজিক সংস্কৃতির প্রভাব থেকে তারা মুক্ত।
এদের পাশাপাশি আরো এক সমাজ আছে, এরা চা বাগানের মালিক, বড় কর্তা ও সম্মানিত অতিথি। পুরো চা বাগানের দেখভালের জন্য কিছু শিক্ষিত কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। চা শ্রমিকদের কাছে যারা দেবতার সমান। তাদের সেবা শুশ্রূষা ও সম্মানের জন্য শ্রমিকদের আন্তরিকতার অন্ত নেই। তরুণ কোনো ছেলে জয়েন করলে তার একটু দেখা পাওয়ার জন্য, তার সাথে একটু কথা বলার জন্য, একটু সময় অন্তরঙ্গে কাটানোর জন্য প্রতিযোগিতার অন্ত থাকে না মেয়েদের মাঝে। বাংলার স্বাভাবিক সমাজে কোনো মেয়েই তার বান্ধবীদের কাছে গিয়ে বলবে না সে তার বড় অফিসারের সাথে অভিসারে গিয়েছিল। কিন্তু চা বাগানে এটা খুব গৌরবের বিষয়। অহংকার করে প্রচার করে এরকম খবর। শত শত বছর ধরে বিচ্ছিন্ন সে সমাজে এগুলোই এখন স্বাভাবিক বাস্তবতা।
একজন সুশীল হিসেবে যে জিনিস আপনি এই সমাজে বাস্তবায়ন করতে চাইছেন, সেটা শত বছর আগেই নিজ গতিতে বাস্তবায়িত হয়ে আছে চা বাগানের পরোক্ষ কৃতদাসদের সমাজে।
এরকম হাজারো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ দেওয়া যাবে যা তাদেরকে আলাদা করেছে বাইরের জগত থেকে। বাইরের মানুষেরা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন বলে তাদের ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির কথাগুলো উঠে আসে না কারো কলমে। দেখা যায় না তেমন কোনো ভিডিও। পত্রিকায় কখনো তাদের খবর পাওয়া যায় না, টেলিভিশনে তাদের কোনো ঘটনার কথা শোনা যায় না। হয় না তাদের নিয়ে তথ্যবহুল কোনো বই।
তবে তার মাঝেও কেউ কেউ কিছু করার চেষ্টা করেন। এমনই একটি প্রচেষ্টা হচ্ছে মোরশেদ আলম হীরার এই বইটি। লেখক তার চাকরিজীবনের শুরুতে জেমস ফিনলে টি এস্টেটে কাজ করেছিলেন। ঘুরেছিলেন বাগানে বাগানে। কাছ থেকে দেখেছিলেন চা শ্রমিকদের জীবন। অনুধাবন করেছিলেন চা বাগানের সমাজ ও বাস্তবতা। সে বিষয়গুলো নিয়ে তিনি একটু একটু করে স্মৃতিচারণা করেছেন সময়ে সময়ে। সেসব স্মৃতিচারণার গ্রন্থিত রূপ হলো এই বই- 'চা বাগানের বিচিত্র জীবন'।
খুব সুন্দর উনার ভাষা। তরতর করে পড়ে ফেলা যায় একেকটি অধ্যায়। পড়ে মজা পাওয়া যায়। তবে বইটা চা বাগানের জীবন, সমাজ ও সিস্টেম নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই নয়। চা বাগান নিয়ে সে অর্থে গোছানো ও তথ্যবহুল নয়। আসলে এটা মূলত লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা ও অভিজ্ঞতার বই। অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকথার ফাঁকে ফাঁকে চা বাগানের নানা বিষয় উ��ে এসেছে।
তবে এ বই পড়ে মনে হয়েছে, লেখক যদি চান এবং চেষ্টা করেন তাহলে চা শ্রমিকদের নিয়ে খুব সুন্দর, গোছানো ও তথ্যবহুল করে একটি বই তিনি লিখতে পারবেন। যে বই বাংলা ভাষায় এবং ইংরেজি ভাষায় থাকা খুবই জরুরি। এতদিন হয়ে গেল শত বছর পেরিয়ে গেল কিন্তু তাদের নিয়ে সে অর্থে ইনডেপথ কোনো বই নেই তা কীভাবে হয়? এই রিভিউয়ের মাধ্যমে লেখকের কাছে সেই আবেদন রইলো। ধন্যবাদ লেখককে চা বাগান নিয়ে বই লেখার জন্য।
চা বাগান ও চা শ্রমিকদের সম্পর্কে যারা আগ্রহী, তারা অবশ্যই এই বই পড়ে দেখবেন।
সিরাজাম মুনীর শ্রাবন
গুডরিডস থেকে প্রাপ্ত।তরঙ্গ।