ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, September 15, 2023

হারিয়ে যাওয়া সাবমেরিন ও রিকশার গল্প

।।অর্ঘ্য প্রতীম ঘোষ।।


 একটা সাবমেরিন হারিয়ে গেছে। একটা বেসামরিক সাবমেরিন। পাঁচজন যাত্রী নিয়ে কোন এক জুন মাসের বিকেলে সাবমেরিন টি ডুব দিয়েছিল আটলান্টিক এর অতলে।

ক্যাপ্টেন মারডক আগেরদিন সন্ধ্যায় দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছিলেন। পঞ্চাশ পেরোনো এই লোকটির সুঠাম বাহু আর পোড় খাওয়া চামড়ার দিকে তাকিয়ে যে কেউ অনুমান করে নিতে পারবে সমুদ্রের সাথে এর বহুদিনের ওঠা বসা। সাবমেরিনের মালিক মারডক কে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, চারজন যাত্রী মোট প্রায় দশ লক্ষ ডলারের টিকেট কেটে এই যাত্রায় সামিল হয়েছেন। সম্ভাব্য আট ঘণ্টার এই যাত্রাপথে তাদেরকে যেন সর্বোচ্চ আতিথেয়তা নিশ্চিত করা হয়। 

মারডক সপ্তাহখানেক আগেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আতিথেয়তার রীতিনীতি সম্পর্কে তার জ্ঞান নিতান্ত কম নয়। এই সেদিনও তিনি সুপারমার্কেট থেকে সুপারমার্কেটে ছুটেছেন আপ্যায়নের নানা জিনিসের বন্দোবস্ত করতে। অতিথিদের তালিকা করা, চার্চের ব্যবস্থা করা, গাউন কেনা- একটা বিয়ে মানে কম ঝক্কি তো নয়। বরং সমুদ্রে ঝক্কি এর চেয়ে অনেক কম। ঢেউয়ের ওপর ভেসে পড়লেই হলো। বাকি দায়িত্ব সমুদ্রই কাঁধ পেতে নেয়। 

সাবমেরিনে ডুব দেয়ার ব্যাপারটা অবশ্য একটু আলাদা। পেরিস্কোপের ভেতরে যেটুকু দেখা যায়, তা ছাড়া পুরোটাই অন্ধকার। এত বছরের অভিজ্ঞতায় যে মাত্র দু'বার তিনি সাবমেরিন নিয়ে ডুব দিয়েছেন এর কারণ এই দমবন্ধ পরিবেশ। এতদিন পরে আবার "হেল্ম" এ হাত রাখতে যাচ্ছেন বেশ মোটা অঙ্কের টাকার হাতছানি পেয়ে। "টাইটান" নামের এই সাবমেরিন আদতে এক প্রমোদতরী। রোমাঞ্চপ্রিয় ধনকুবেরদের সমুদ্রতলের নানা অদ্ভুত ও আশ্চর্য স্থানে নিয়ে যায় এই ডুবোজাহাজ। আকাশচুম্বী এর একেকটি সিটের দাম। এর কোনো কোনো ডেস্টিনেশনের টিকেট এক বছর আগে থেকে রিজার্ভ হয়ে আছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। টাইটানের হেল্ম এর দায়িত্ব পাওয়া তাই যক্ষের ভাঁড়ার হাতে পাওয়ার মত। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, স্ত্রীকে নিয়ে একটা সুন্দর অবসর জীবন কাটাতে টাইটানে মাত্র আট ঘন্টার জন্যে ক্যাপ্টেন হওয়াই মারডক এর জন্য যথেষ্ট। এমন প্রস্তাব সামনে পেলে ওসব দমবন্ধ পরিবেশে সারাদিন কাটিয়ে দিতেও রাজি মারডক।

পরদিন জেটিতে তার চার সহযাত্রীর সাথে মারডক কে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। সালমান নামের ছেলেটির বয়স সবচেয়ে কম। দুবাইয়ের ধনকুবের এক শেখের ছেলে। হার্ডিং নামের এক ভদ্রলোক আছেন। ষাটের উপর বয়স। ভূপর্যটক, অকৃতদার এবং বেশ রসিক। নেদারল্যান্ডস এ একটা ছোট্ট গ্রামে থাকেন। বেশ কিছুদিন আগেই তিনি উত্তর মেরু থেকে ঘুরে এসেছেন। তার অগাধ অভিজ্ঞতার গল্প তিনি সহযাত্রীদের ধরে ধরে শোনাচ্ছেন।

একজন ফরাসি ধনকুবের আছেন। নাম লুই। সম্ভবত ইংরেজিতে তিনি স্বচ্ছন্দ্য নন অথবা কম কথা বলেন। মারডক ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফরাসিতে নানা কথা বলবার চেষ্টা করে শুধু জানতে পারলেন তাঁর এভিয়েশনের ব্যবসা আছে।

আরেকজন অতিবৃদ্ধ ইংরেজ ভদ্রলোক। ধনকুবের বলতে যা বোঝায় ইনি তা নন। জীবনের সঞ্চিত সম্পদের প্রায় পুরোটাই বিক্রি করে তিনি এসেছেন এই যাত্রায় সামিল হতে। এনার নাম জনসন।
মারডক সকলকে অভিবাদন জানালেন। একে একে সকলে উঠে পড়লেন ২২ ফুট দৈর্ঘ্যের সাবমেরিনে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ভেতরে বসার জন্যে কোন আসন নেই। একটি মাত্র জানালা দিয়ে যাত্রীরা দেখল সমুদ্রের বুক ফুঁড়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য।

মারডক সংকেত দিতেই "পোলার প্রিন্স" নামের একটা জাহাজ টাইটান কে ছেড়ে দিল উত্তর আটলান্টিকের বুকে। এ যাত্রায় ডুব দেবে ১২ হাজার ফুট নিচে। যেখানে রয়েছে শত বছরের পুরনো টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ। সেই টাইটানিক, যার নাম থেকেই এই ডুবোজাহাজের নামকরণ। সেই টাইটানিক, যার কথা শুধুমাত্র কল্পনা করলেই ভেতরে বসে থাকা যাত্রীদের চোখ চকচক করে ওঠে। রূপকথা, কিংবদন্তি, প্রেম, দৈব আর ট্র্যাজেডির সমার্থক, দৈত্যাকার টাইটানিক আর সম্ভবত তিন ঘণ্টা পরে থাকবে হাত ছোঁয়া দূরত্বে।

এর ঠিক দেড় ঘণ্টা পরেই সারা বিশ্বের সাথে টাইটানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আটলান্টিক এর বুকে পাঁচ যাত্রী নিয়ে এক সাবমেরিনের নিখোঁজ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে।
একটি রিক্সাও হারিয়ে গেছে।

সেই সন্ধ্যায়, আটলান্টিক থেকে লক্ষ মাইল দূরে, ঢাকা শহরের বুকে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে চালকসহ একটি রিক্সা হারিয়ে যাওয়ার খবর কোন পত্রিকায় ছাপা হয়নি। এমনকি কোন ফেসবুক পোস্ট ও কারো চোখে পড়ে নি। অথচ বিশাল, বিপদসংকুল আটলান্টিক এর বুকে একটা সাবমেরিন হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে জনবহুল ঢাকা শহরের গলিতে যাত্রীসমেত একটা রিক্সা হারিয়ে যাওয়া হাজারগুনে চমকপ্রদ খবর হওয়ার কথা। ঘটনাটি একটু জানা যাক।

আবুল ফোনে তার বউকে অশ্রাব্য চার পাঁচটি গালি দেয়ার পরে ফোন কেটে একটা বিড়ি ধরিয়েছিল। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে সন্ধায় সাধারণত সে বাড়ি ফেরে। কিন্তু আজ বউয়ের সাথে ঝগড়া করে মেজাজ খিচে আছে। বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না। বাড়িতে বউ ছাড়াও এক সমত্ত মেয়ে আছে। বিয়ে দেয়া দরকার। রোজ বাড়িতে ফিরলেই তার মেয়েকে নিয়ে এজন ও জনের নানা কানাঘুষো শুনতে হয়। এই নিয়েই বউয়ের সাথে তার রোজ লাগে। বিয়ে কী ট্রাফিকের মামলা নাকি যে চাইলাম আর দিয়ে দিলাম! খরচের ব্যাপার আছে। একা এক রিক্সা টেনে এক মেয়ের বিয়ে দেয়ার খরচ জোগাড় করা কী কষ্টের কাজ, ঘরে বসে হাঁড়ি ঠেলা মাগীরা ওসব বোঝে না। এই জন্য প্রায় রাতেই সে তার বউ আর মেয়েকে বেদম পেটায়। তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

কিন্তু আজ ঘরে ফিরতেই ইচ্ছা করছিল না। আরো ক'টা খ্যাপ মেরে তারপর বাড়ি ফিরবে এমন একটা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনই একটা ছেলে তাকে ডাকে। ছেলেটির সাথে একটা মেয়ে, হাত ধরা। মেয়েটির হাতে একটা স্যুটকেস। বাসাবো যাবে। আবুল রাজি হয়। মেজাজ খিচে থাকায় ন্যায্য ভাড়ার প্রায় দেড়গুন ভাড়া দিয়ে আবুলের সাথে যাত্রায় সামিল হয় যাত্রী দু'জন।
এই পর্যায়ে যাত্রী দুজনের গল্প একটু শোনা যাক।

ছেলেটির নাম মুকুল। বছর দুই আগে অনার্স পাস করেছে। চাকরি পায়নি।
মেয়েটির নাম বন্যা। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাবা শিল্পপতি।
মুকুলের বাবা কিছুই না। কিছুই না মানে একটা গ্রামের স্কুলের টিচার। অবশ্য এখন ওনাকে আর মুকুলের বাবা বলা যায় কী না সেটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। কিছুক্ষণ আগে যখন মুকুল আর বন্যার বিয়ের খবরটা তার কানে গিয়েছে তখনই মুকুলকে সে ত্যাজ্য পুত্র করেছে। পালিয়ে বিয়ে করার খবর বন্যার বাবার কানেও গিয়েছে। তবে তিনি এখনো মেয়েকে ত্যাজ্য করেন নি। তিনি অন্য লাইন ধরেছেন। পরিচিত মাস্তান টাইপের ছেলেপুলে লাগিয়ে দিয়েছেন। মেয়েকে জীবিত চান, মুকুলকে জীবিত বা মৃত। সম্মানের কথা ভেবে এখনো পুলিশকে জানান নি। তিনি আশা করছেন লাগবেও না।
মুকুল আর বন্যা এদিকে কোর্ট ম্যারেজ টা শেষ করেই পুরো ঢাকা প্রায় চক্কর কেটে বেড়াচ্ছে মাস্তানদের চোখে ধুলো দিতে। আপাতত বাসাবোতে তার এক পরিচিত বন্ধুর বাড়িতে উঠতে পারলেই এ যাত্রায় বেঁচে যাওয়া যাবে বলে তাদের বিশ্বাস।

আবুলের রিক্সায় ওঠার সময় মুকুল হিসাব করেছে বাসাবো যেতে আর চল্লিশ মিনিট মত লাগতে পারে। ঠিক চল্লিশ মিনিট পরেই তার আর বন্যার সামনে যে জীবন হাতছানি দিচ্ছে - রোমাঞ্চে, রূপকথায়, প্রেমে, দৈবে কিংবা বিরহে সেটা টাইটানিকের চেয়ে কম কীসে?

সমস্যাটা প্রথমে আবুল ধরতে পারে নাকি মারডক সেটা জানা যায় নি। কিন্তু দুজনেই টের পায় কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে। মারডক যখন দেখল তার সাবমেরিনের সবগুলো রেডিও সিগন্যাল দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে, রাডার এই কাজ করছে তো এই কাজ করছে না - কিছুক্ষণের জন্য সে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট এই সাবমেরিনে ক্যাপ্টেনের জন্য আলাদা কোন কক্ষ নেই। তার ঠিক পেছনেই যাত্রীরা গোল হয়ে বসে। হার্ডিং সমানে বকবক করে যাচ্ছে। লুই কোন কথা শুনছেন না। জনসন একদৃষ্টে তাকিয়ে অন্ধকার সমুদ্র দেখছেন। সকলেই ভাবছেন গন্তব্য আছে, অথচ টাইটান হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে! মারডক একবার ভাবলেন কাউকে কিছু না জানিয়েই ওপরে ওঠা শুরু করবেন। পাঁচজন মানুষের আঠারো ঘণ্টা চলার মত অক্সিজেনের মজুদ আছে টাইটানে। গন্তব্যহীন যাত্রার বাহন হিসেবে মোটেই উপযুক্ত নয় টাইটান। ভেসে ওঠার সিদ্ধান্ত নিতেই দ্বিতীয় গোলমালটা আবিষ্কার করলেন মারডক। টাইটান তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। ২২ ফুটের এই ডুবোজাহাজ লাগামহীন ছুটে চলেছে সমুদ্রের গভীরে। এতদিনের সমুদ্রজীবনে প্রথমবার হেল্ম থেকে হাত ছুটে গেল মারডক এর।

আবুল এদিকে ভাবছে তার নেশা ধরে গেছে। মৌচাক মোড় থেকে মালিবাগ রেলগেটের দিকে এই রাস্তাটায় গাড়িঘোড়া আর মানুষ মিলে এমনিতেই সমুদ্রের মত অবস্থা। জ্যাম ঠেলে রিক্সা নিয়ে আগানোই কঠিন। এদিকে প্যাসেঞ্জার ছেলে মেয়ে দুটো অনর্গল গল্প করে চলেছে। আবুল আগেই বুঝেছে এরা পালিয়ে বিয়ে করা কেস। নতুন নতুন দুনিয়ার রংতামাশা দেখছে। দুইদিন পরেই টের পাবে দুনিয়া কি জিনিস। প্রথম প্রথম তারও বউকে মারতে খারাপ লাগতো। মায়া হত। এখন শান্তি লাগে। মনে হয় শাকচুন্নিটা মরলে বেঁচে যায়। খিলগাঁও পার হয়েই বামে একটা গলিতে ঢুকেছিল আবুল। এরপরেই রাস্তাঘাট কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। এমনিতে এদিকের পথঘাট তার মুখস্থ। কিন্তু এখন কেন যেন কিছুতেই মেলাতে পারছে না। 

বেশি বিড়ি টানলে এমন নেশা হয় কি না জানেনা আবুল। ছেলেটাকে একবার জিজ্ঞেস করল কোনদিকে যাবে। ছেলেটাও মনে হল চেনেনা ভালো। ঠাওর করতে পারছে না কোন দিকে যাওয়া উচিত। আবুল একবার ভাবলো রিক্সা ঘুরিয়ে মেইন রোড দিয়েই যাবে। গোলমালটা ধরা পড়ল তখনই। রিক্সার হ্যান্ডেল ঘোরানো যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, সে প্যাডেল করাও থামাতে পারছে না। এক অনির্দেশ গন্তব্যে তার রিক্সা সোজা এগিয়ে চলছে। পেছনে মুকুল এক আঙ্গুল দিয়ে বন্যার মুখের উপর চলে আসা চুল সরিয়ে দিচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে রিক্সা প্রয়োজনের চেয়ে জোরে চলছে। এত জোরে ছোটার তো কিছু নেই। একবার ভাবলো মামাকে বলবে আস্তে চালাতে। কিন্তু বন্যার চোখের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ে যাওয়ায় ওসব চিন্তা কোথায় হারিয়ে গেল। এই রিক্সাটার মতই।

সচরাচর এত রাত করে না মোমেনার বাপ। সন্ধ্যায় একবার ফোন দিয়ে গালাগাল খেয়েছে আবুলের বউ। ভেবেছিল আর ফোন টোন করবে না। কিন্তু এখন রাত হওয়ায় তার চিন্তা হচ্ছে। লোকটা পশুর মত মারে, অশ্রাব্য গালাগাল দেয়। তবু ঘরের মানুষ তো। শুকনো ভাত সামনে নিয়ে তাই আরেকবার ফোন দেয় আবুলের বউ। ফোন বন্ধ। অনেকক্ষণ ধরেই। মেয়েটাও খায় নি। রাগ করে যদি আজ রাতে বাড়ি না আসে আবুল? কিছুই হয়তো হবে না। কিন্তু যদি কাল ও না আসে? পরশু ও? কোনদিনই যদি আর না আসে? ওদেরকে ত্যাগ দেয়ার একটা উড়ো খবর অনেকদিন ধরেই শুনে আসছিল আবুলের বউ। গার্মেন্টস এর একটা মেয়ের সাথে আবুলের মেলামেশার গল্পও শুনেছে। ভয়ে গলা কাঠ হয়ে আসে। এত বড় মেয়েটাকে নিয়ে এই বস্তিতে তার সামনে যে জীবন পড়ে সেটাই বা টাইটানিকের চেয়ে কম কী!

টাইটানিক! সবচেয়ে বড় প্রমোদতরী। বিলাস, জৌলুস আর আভিজাত্যের চূড়ান্ত দম্ভ নিয়ে যে ডুবে গিয়েছিল আটলান্টিক এর গভীরে। সেই টাইটানিকের সামনে টাইটান। ভেতরে পাঁচজন। যার মধ্যে অন্তত চারজন লক্ষাধিক ডলার খরচ করেছিল শুধু এই টাইটানিক এর ভাঙাচোরা অবশেষ একবার দেখবার জন্য। অথচ কী অদ্ভুত মিলন! টাইটান টাইটানিক কে রেখেই ছুটছে আরো গভীরে। যে অন্ধকার তলদেশে পৌঁছায় নি কোন আলো।

টাইটানের ভেতরে তখন থমথমে পরিবেশ। আরো আধঘণ্টা আগে, মারডক এর কাছে আসন্ন বিপদের বিবরণ শোনার কিছুক্ষণ পরেই আত্মহত্যা করে হার্ডিন। সারাক্ষণ বকবক করতে থাকা এই লোকের নিথর দেহ পড়ে আছে এক কোণে। সালমানের একটা হাত রক্তাক্ত। হঠাৎ মেজাজ হারিয়ে সে মারডকের নাকে ঘুষি মেরেছিল। মারডক নাকের রক্ত থামানোর জন্য কোন তোড়জোড় করে নি, কোন এক অদ্ভুত কারণে সে টাইটানের অকেজো হেল্ম ধরে দাঁড়িয়ে আছে নাবিকের মত। তার সারা জীবনের অভ্যেস।

টাইটান ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে আরো অতলে। এরই মধ্যে কোন এক সময়, টাইটানের একমাত্র জানালায় ভেসে ওঠে টাইটানিকের অক্ষত হাল! লুই ও ততক্ষণে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।
আবুলের জিহ্বা বেরিয়ে আসছে। ক্রমাগত প্যাডেল মারতে মারতে তার বুক হাপরের মত ওঠানামা করছে। টানা এতক্ষণ সে কখনোই রিক্সা চালায় নি। ওর মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে। মরে গেলে অনেকগুলো ঝামেলা চুকে যায়, কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারনে সে বাঁচতে চায়।

পেছনে মুকুল আর বন্যা অবশ্য একটা অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করছে। এই রিক্সা যদি আর কখনোই না থামে, কারও বাবাই আর তাদের ধরতে পারবেনা। সে চিৎকার করে করে মামাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। চালাও মামা, থামার দরকার নাই। তোমার ভাড়া বাড়িয়ে দিব। চলতে থাকো। হোক অনির্দেশযাত্রা, তবু তুমি চলো। মুকুল পারলে তার সমস্ত সম্পদ উজাড় করে দেয় আবুলের সামনে। বন্যার হাত চেপে ধরে। এ যেন এক স্বপ্ন যাত্রার পথে তারা ছুটছে। কল্পনার চোখে সে নিজেদের দেখতে পায় টাইটানিক সিনেমার সেই বিখ্যাত দৃশ্যে জ্যাক আর রোজের জায়গায়।

আবুলের অবসন্ন দেহ ক্রমে লুটিয়ে পড়ে। প্যাডেল তবু থামে না। মারডক সাবমেরিনের প্যানেলের উপরই মাথা এলিয়ে দেয়। তার দম বন্ধ লাগছে। লুই একটা ব্লেড নিয়ে অনেকবার হাতের ওপর আঁচড় কাটে। তবু মৃত্যু যেন আসে না। টাইটান এগিয়ে চলে। কপর্দকহীন সেই বৃদ্ধ জনসন শুধু জানালায় সেঁটে আছে। তার চোখের সামনে স্বয়ং টাইটানিক। প্রাণভরে সে দেখতে থাকে বিধ্বস্ত টাইটানিকের ভয়ংকর সৌন্দর্য। ঐতো গলুই, হাল। ভাঙাচোরা ডেক, কিছু কেবিন এখনো টিকে আছে। টাইটানিকের সাথে তার জীবনের কোন যোগ নেই। তিনি যে জাহাজ প্রেমী তাও নন। সত্যিই তিনি ঠিক জানেন না কেন প্রায় সমস্ত সম্পদ বিক্রি করে তিনি এই বিলাসী ভ্রমণের অংশ হয়েছিলেন। তিনি জানেন না সমুদ্রতলের অন্ধকারে, দুই হাজার মিটার ব্যবধানে পড়ে থাকা ভাঙা জাহাজের দুটো টুকরো দেখে তিনি কী করবেন। তবু তিনি দেখছেন। জাহাজের জং ধরা, শীর্ণ, বৃদ্ধ শরীর দেখে তিনি পুলকিত হচ্ছেন। তার শরীর বারবার কাঁটা দিয়ে উঠছে।

সাবমেরিন টাইটান উদ্ধার করা যায় নি। পাঁচজন যাত্রীর সবাইকে মৃত ঘোষণা করে বিবৃতি দেয়া হয়েছে।
আবুলের রিক্সাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন বিবৃতি কোথাও আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নি।

।।অর্ঘ্য প্রতীম ঘোষ।।