ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Wednesday, December 2, 2020

আলী যাকেরের বিদায়

।অপু চৌধুরী।।আসিফ মুনীর।।বদরুজ্জামান আলমগীর।।

আলী যাকের, ১৯৮৮, ব্রিটিশ কাউন্সিল ঢাকা।ডেবোরা ওয়ার্নার নির্দেশিত 'টেম্পেস্ট' নাটকে।বামে ফেরদৌসি মজুমদার।

আলী যাকের, যাকে তার ঘনিষ্ঠজনরা এবং নাটকের মানুষেরা ছোটলু ভাই বলে সম্মোধন করতেন। আমার নাটকে হাতে খড়ি ছোটলু ভাইসহ নাগরিকের অন্যান্য অগ্রজদের কাছে।
অনেকে হয়তো তাকে চেনেন টেলিভিশন নাটকের মাধ্যমে বা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুবাদে। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রথমত একজন মঞ্চ অভিনেতা। আমরা অনেক বিখ্যাত অভিনেতার নাম শুনেছি, যেমন- শিশির ভাদুড়ী, গিরিশচন্দ্র, অথবা স্যার লরেন্স অলিভিয়ের। তিনি ছিলেন সেরকমই আন্তর্জাতিক মানের একজন মঞ্চ অভিনেতা। এবং আমার মতে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মঞ্চ অভিনেতা। তিনি বাংলাদেশের মঞ্চে ম্যাকবেথ, গ্যালিলিও গ্যালিলি, নুরুলদীন, দেওয়ান গাজী, টেম্পেস্ট সহ যেসব চরিত্রে অভিনয করেছেন তা ভোলার নয়।

আমার পরম সৌভাগ্য যে তার নির্দেশনায় অভিনয় করেছি, তার সান্নিধ্য ও স্নেহ পেয়েছি এবং নাটকে বহু কিছুই তার কাছ থেকে শিখেছি। মঞ্চে তার অভিনয় বা নির্দেশনা দেখাটা ছিল মাস্টার ক্লাস এর মত। মঞ্চে তাঁর অভিনয় যারা দেখেননি তারা সত্যিই একটা বিরল অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আধুনিক নাট্যচর্চার পথিকৃৎদের মধ্যে তিনি অন্যতম। নিয়মিত মঞ্চনাটক দেখা ও মঞ্চনাটকের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে আমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারি।
বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রিয় ছোটলু ভাই।

অপু চৌধুরী
২৭/১১/২০
ম্যাঞ্চেস্টার, যুক্তরাজ্য

খুব কাছের মানুষ, মনের মানুষ চিরতরে চলে গেলে তাঁদের নিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত লিখতে বা কিছু বলতে কষ্ট হয়। তাঁদের সাথে নিয়মিত দেখা না হলেও মনের কাছেই থাকেন, চলে গেলে কষ্ট বেড়ে যায়। ছোটলু ভাইকে নিয়ে কিছু বলতেও তাই হচ্ছে। তবে সংস্ক্রিতিকর্মী যারা তাঁকে কাছে পেয়েছেন বা সুযোগ হয়নি, সবাইকেই তিনি কিভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন এবং করে যাবেন, সেটা জানিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা থেকেই একটু লিখছি আর কয়েকটি ছবি দিচ্ছি।

সেক্সপিয়ারের টেম্পেস্ট নাটকে কি অনবদ্য অভিনয় তাঁর! রয়েল সেক্সপিয়ার কোম্পানির জাঁদরেল তরুণ নির্দেশক ডেবোরা ওয়ার্নার creative perfectionist, কিন্তু ছোটলু ভাইয়ের মত জাঁদরেল অভিনেতাকে খুব বেশি কিছু বলে বা দেখিয়ে দিতে হয়নি। অনেক দল থেকে বাছাই করা অভিনেতা ও নেপথ্য কর্মী নিয়ে প্রোডাকশনটি হয়েছিল। আমার সৌভাগ্য ছোটলু ভাই সহ আমি তাঁদের সান্নিধ্য পেয়েছি, এই নাটকের নেপথ্য কর্মী হিসেবে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাছাকাছি থাকতাম বলে সবার পোশাক থাকতো আমার কাছে, ছোটলু ভাইয়ের গায়ের তালিমারা ছেঁড়া কোটটি সহ। জামিল ভাই-এর পরামর্শে ওটায় রকমারি জিনিষ সেলাই করে আনতাম নীলক্ষেত থেকে, কুড়িয়ে পাওয়া বানরের এক টুকরো হাড় সহ। পরম যত্নে তুলে দিতাম ছোটলু ভাইয়ের হাতে। তিনি দাপটে ওটা গায়ে দিয়ে অভিনয় করে, শো শেষে স্মিতহাস্যে আবার যত্নে আমার হাতে তুলে দিতেন। শক্তিশালী এই অভিনেতার অনেক অভিনয়ের মত টেম্পেস্ট-এর প্রস্পেরো চরিত্রের অভিনয়ও ছিল মনে রাখার মত।

আমাদের নাটকের দল বঙ্গরঙ্গ প্রায় প্রত্যেক কর্মশালায় ছোটলু ভাইকে নিয়ে এসেছি আমরা। আশির দশকে কর্মশালায় আমরা যেমন ছোটলু ভাই-এর কাছে নাটক সম্পর্কে জেনেছি ও শিখেছি, পরের কয়েক দশকেও অনেক নাট্যকর্মী তৈরিতে তিনি অবদান রেখেছেন। অনেক নাটক পাগল, অনেক তুখোড় নাটুকের নাট্যগুরু, সকলের প্রিয় ছোটলু ভাই। আলী যাকের।বাবার** জন্মদিনে ছোটলু ভাই চলে গেলেন। প্রতি বছর দুজনকে আরও বেশি করে মনে পড়বে।

আসিফ মুনীর
২৭/১১/২০
ঢাকা, বাংলাদেশ

থিয়েটারে ভারসাম্য বিন্দু
অদ্ভুত একটি কথা বলেছিলেন আমার নাট্যগুরু মুহম্মদ বাকের, আমি তখন ঢাকা শহরে আসিওনি। সেইসময় সরিষাপুর গ্রামই ছিল আমাদের ঢাকা শহর- এনএসডি, মণিপুর, কী মস্কোর বলশোয় থিয়েটার। ৮দশকের গোড়ায় এই একটি গ্রামেই হচ্ছে ইডিপাস, নাট্যকারের সন্ধানে ছয়টি চরিত্র, হইতে সাবধান, সাজাহান, মহাবিদ্রোহ- এমন সব নাটক।

মুহম্মদ বাকের হাই ইশকুলে পড়া একটি ছেলেকে বলেন- তুমি যদি কোনদিন নাটক লিখতে আসো, তাহলে ঢাকায় গিয়ে প্রথমেই দেখবে কিত্তনখোলা- তাতে তোমার একটি চোখ খুলবে- তুমি তখন একচক্ষু হরিণ; তোমার আরেকটি চোখ খোলার জন্য কোপেনিকের ক্যাপ্টেন দেখতে ভুলো না। তা যদি না করো- অবলীলায় শিকারীর বল্লমে বিদ্ধ হবে- কেননা, তুমি তাহলে অর্ধেক দেখায় সক্ষম, পুরোটা দেখার জন্য বাঙলা মীড়ের নাটক যেমন দেখতে হবে, সেইসাথে দেখবে ইউরোপীয় ঘরানার থিয়েটার।

অভিনয়ের বিষয়েও তেমন অবধ্য একটি কথা বলেছিলেন মুহম্মদ বাকের: বাঙলা অভিনয়ের পরম্পরাটুকু বোঝার জন্য খেয়াল করে দেখো যাত্রা আঙ্গিকের এক বিপুল অভিনেতা কামালপুরের হরিদাস বণিকের অভিনয় শৈলী, আবার পরখ করো আমাদেরই গ্রামের কিসসাকার চিনির বাপের বেহুলার পালা, চান্নি রাতে কুপিবাতির নিচে শোনো কেমন মায়ামায়া সুরে পুঁথি পড়েন রফু মিয়া, আলিয়াবাদে আসে প্রতিবছর গোপালের পাঠাভিনয়ে রামায়ণ, বাজারে বাজারে নিজের কবিতা গেয়ে শোনান আমাদেরই গ্রামের ইল্লাস কবিয়াল, তমাল তলায় খোল করতালে হয় লৈকো বিলাস, প্রতি আশুরায় ভেইক্কা চান্দুর বাড়িতে বসে কারবালার জারীর মর্সিয়া- ওখানে বেদনার সঞ্চারে মন ভরে তোলো; আর তাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখো আলী যাকেরের ক্যারেক্টার এক্টিঙের বৈভব।

সবটা মিলেই দুনিয়া, অভিনয় আর থিয়েটার; একটাকে বাদ দিলে আরেকটা নালায়েক। ছটফটে অভিনেতা যেমন লাগবে, থাকতে হবে লাম্বা গীতের গায়ন, সেইসাথে আলী যাকেরের মঞ্চভরাট গ্যালিলিও গ্যালিলেও তেমনি অপরিহার্য পাঠ।

সেইসময়েই আমি প্রথম শুনি- নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় বলে একটি থিয়েটার গ্রুপ আছে- তাদের মধ্যমণি আলী যাকের; যাঁরা নাটকে বাঙলা আর বিশ্বকে একসুতায় বাঁধেন; তাঁরাই মাইকেল মধুসূদন দত্ত,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাঈদ আহমদ যেমন মঞ্চে তোলেন, তেমনি পরিবেশন করেন কার্ল জুকমায়ার, সেমুয়েল ব্যাকেট, আরউইন শ, বার্টোল্ট ব্রেশট।

আলী যাকের শুরু করেছিলেন আরণ্যক নাট্যদলে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় কবর নাটকের মধ্য দিয়ে।তারপর নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের বিভিন্ন নাটকে দুর্দান্ত অভিনয়ে, নির্দেশনার হেডমে ঢাকার মঞ্চে একেকটি মহীরুহ নিদর্শন সৃষ্টি করেছেন আলী যাকের। দেওয়ান গাজীর কিসসা, গ্যালিলিও, নূরলদীনের সারাজীবন, ক্রিস্টোফার স্যানফোর্ডের নির্দেশনায় ম্যাকবেথ, ডেবোরা ওয়ার্নারের টেম্পেস্টে আলী যাকেরের অভিনয় এখনও চোখে জ্বলজ্বল করে ভাসে।

আমার মধ্যে একটা অমোচনীয় অসুখ আছে- যারা বিখ্যাত মানুষ, বা যাদেরকে লোকে স্টার বলে- তাদের থেকে ১০হাত দূরে থাকা।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন একবার আকস্মিকভাবে আমার বন্ধু চয়ন খায়রুল হাবিবের উসকানিতে তার সঙ্গে নাগরিকের মহড়া কক্ষে গিয়ে হাজির হই। সেদিন আলী যাকের শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ ছিলেন- কিন্তু তারপরও তিনি গ্রামের একটি ছেলের সঙ্গে স্নেহশীলভাবে কথা বলেছিলেন, তাঁর হাসিটিও খাঁটি ছিল। আমার এখনও মনে পড়ে! ওখানেই দেখি- নিকটজনরা তাকে ছটলু ভাই বলে ডাকে।

সবকাজে, সিদ্ধান্তে আলী যাকেরের মুক্তিযুদ্ধমুখী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চৈতন্যটি আমাদের আকাঙ্ক্ষার সহযাত্রী হবে। তাঁর নাগরিক কল্যাণার্তি টেলিভিশন, বা সিনেমায়ও সমানভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য- বহুব্রীহি, আজ রবিবার, নীতু তোমাকে ভালবাসি, নদীর নাম মধুমতি, লাল সালু, রাবেয়া- আলী যাকের-এর অভিনয়ে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।

এইমুহূর্তে বাঙলাদেশের নাটকে একটি একহারা ব্যাপার যাচ্ছে- স্যামুয়েল বেকেট, বা ডেভিড ম্যামেট, কী অ্যানি বেকারের একটি ট্যাক্সট হয়তো কুদ্দুস বয়াতীর অভিনয়াঙ্গিকে মঞ্চে তুলে আনা হলো- তখনই নিজেনিজে একটু শিউরে উঠে ভাবতে থাকি- নাটক কোনভাবেই কানাগলি নয়- থিয়েটার ন্যায়বিচারের মতোই একটি স্কোয়ার- অন্তর্গত চারদিক; ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিষবৃক্ষ একেকটি পশ্চিমা নাটক মঞ্চে আনতে চরিত্রাভিনয় লাগবে, বর্ণনাভিনয়ের অতি উৎসাহী জাতীয়তাবাদী ঘেরাটোপে সবকিছুকে আটকে ফেললে তো চলবে না।

থিয়েটারকে একটি সৃজনশীল ভারসাম্য বিন্দুতে মিলাবার যজ্ঞে আপনাকে খুব মনে পড়বে- আলী যাকের!

বদরুজ্জামান আলমগীর
২৭/১১/২০
ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ফটো শহীদুল আলম আসছে, চয়ন খায়রুল হাবিবের লেখা : 'জুলেখা ট্রিলজি'র আলোকে আলী যাকের অভিনিত চরিত্র এবং নাট্যকারগন'