ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, November 21, 2020

অন্যরকম ঈদ। ২০২০।

।।বাবলী হক।।

উর্দু রোডের বাসায় ভাই বোনদের সাথে বাবলী হক, ষাটের দশক।

"ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।"
এবার ঈদ এলো কিন্তু খুশি এলো না। এলো ভয়, আতঙ্ক, আশঙ্কা, লক ডাউন, দুঃসংবাদ আর কষ্ট। এই ব্যাতিক্রমী ঈদে করোনা ভাইরাসের সতর্কতায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে আপনজনদের কাছ থেকে আজ কতটা দিন দূরে সরে আছি!
না, মন থেকে কেউ সরে যাইনি। খোঁজ খবর করছে ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা! তবু দেখা তো হচ্ছে না!
একটা সময় ছিল বাবা মার সঙ্গে আমরা সাত ভাই-বোন এক বাড়িতেই ঈদ করতাম। তারপর বড়ো হতে হতে কেউ হয়তো দেশের বাইরে, কেউ শ্বশুর বাড়ি, কেউ কর্মস্থলে চলে গেল। কিন্তু ঢাকায় থাকলে ঈদেরদিন ঠিকই দেখা হতো। ঈদ বলে কথা!

এবার অবিশ্বাস্য ঘটনা, আমরা পাঁচ ভাইবোন ঢাকায় আছি অথচ দেখা হচ্ছে না প্রায় পঁচাত্তর দিন! ভাবা যায়!
প্রতিবছর প্রথম রমজান থেকেই এমদাদ (ছোটো ভাই)একটা গান করত, রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ! আমরা খুব হাসতাম আর বলতাম, ঈদ আসবে একমাস পর!

আজ খুব মনে পড়ছে মার কথা। বাবার কথা। ভোরের আজান শেষ হতে না হতেই মা চলে যেতেন রান্নাঘরে।
মার হাঁকডাক, খুন্তি নাড়ার শব্দ পেতাম বিছানায় শুয়ে। বাবা ছোটো ভাইদের নিজের হাতে স্নান করিয়ে কাপড় পরিয়ে দিতেন। ইতিমধ্যে বড়োরা তৈরি হয়ে চলে এসেছে। ততক্ষণে টেবিলে সেমাইও এসে হাজির। সেমাই খেয়ে আতর মেখে, কানে আতর মাখা তুলা গুজে, বাড়ির ছেলেরা চলে গেল ঈদের জামাতে। আমি দৌড়ে গিয়ে তিনতলার বারান্দা থেকে দেখতাম বাড়ির পুরুষ কাজের লোকগুলোও নতুন জামা কাপড় পরে বাবা আর ভাইদের পিছন পিছন হেঁটে যাচ্ছে! ভাবতাম, আমি কেন ওদের মতো জামাতে যেতে পারি না? এদিকে মা রান্নাঘর থেকে তাড়া দিতে থাকতেন স্নানের জন্য। বিছানায় নতুন চাদর বালিশের কভার পাতা হয়েছে৷ সারা বাড়ি খাবারের গন্ধে মৌ মৌ করছে।

বাবা নামাজ থেকে ফিরে এলেই শুরু হতো কদমবুশির পালা। তারপর ... নতুন কড়কড়ে নোটের, ঈদি।
সন্ধ্যায় চলে যেতাম চকবাজারের মেলায়। মুড়কি, বাতাসা, কদমা, মাসকালাইয়ের মচমচে বড়া আরও কতকিছু! মাটির খেলনা আর সেই যে মাটির ঘাড় দোলানো বুড়া দাদুর মুর্তি কিনতে কখনো ভুলতাম না! বাড়ির সবকয়টা বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের বাড়ির সোনা ভাই হিমসিম খেতেন! আমরা দুষ্টামি করে এদিক সেদিক লুকিয়ে থেকে তাকে আরও ব্যাতিব্যস্ত করে তুলতাম! কিন্ত সোনা ভাই ঠিকঠাক সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। কোথায় গেল সেই ছেলেবেলা!

বাবার আকর্ষিক মৃত্যুর পরও উর্দুরোডের বাড়িতে মাকে ঘিরে সব ভাইবোনের ঈদের দিনে দেখা হত। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলত। সেই আড্ডাও একদিন ভেঙে গেল মা চলে যাবার পর। উর্দুরোডের সেই জমজমাট বাড়ির ঘরগুলিতে এখন তালা ঝোলে!

এরপর ঈদের দিন আমার বারিধারার বাড়িতে সবাই আসত। বনানী কবরস্হানে বাবা মার কবর জিয়ারত করে ভাইবোন তাদের পরিবার নিয়ে দুপুরের মধ্যে সবাই চলে আসত। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত হৈচৈ আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়া! কিন্তু এবার এই প্রথম ফোনে শুভেচ্ছা বিনিময়, বিষন্ন চোখে ভিডিও বার্তায় মন আরও বিষন্নতায় ডুবে গেল!

এখন ভাইবোনেরা শাখা-প্রশাখা মেলে আমরা চব্বিশজন! মন চায়, আবার আমরা সবাই একসঙ্গে হতে চাই...সেই টানা লম্বা বারান্দায়! ফিরে পেতে চাই সেই দিনগুলি!


বাবলী হক
২৪/০৫/২০
ঢাকা