ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, November 27, 2020

রাবেয়া বসরি, দাউদ আল হাফিজ , জর্জ ফ্লয়েড ও জন ওনাসিস

।।বদরুজ্জামান আলমগীর।।

রাবেয়া বসরীর পলাপলি খেলা

সেই সময় রাবেয়া বসরীর নামে একটা গল্প চাউর ছিল : লোকে দেখে তাঁর এক হাতে আগুন আরেক হাতে পানি নিয়ে বেজান দৌড়ে যাচ্ছেন। এই আগুন আর জল দিয়ে রাবেয়া কী করবেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- পানি ঢেলে দোযখের আগুন নিভাবেন, আর আগুন দিয়ে বেহেস্ত জ্বালিয়ে ছারখার করে দেবেন।
ওইসময়ে সুদূর মদিনা থেকে সৈনিক বেশে আসা হাসান ইয়াসার বসরীও পরম ও রাবেয়ার বাঁকা দুই নয়নের নেশায় বসরা নগরীতে আটকা পড়েন। একদিন তারা দুজনে পলাপলি খেলায় মাতে। প্রথম পালা আসে হাসানের- তিনি নানা জায়গা ঘুরেটুরে অতিদূর এক কোণায় লুকান। কিন্তু রাবেয়া বসরীর হাসান বসরীকে খুঁজে পেতে তেমন সময় লাগেনি- সাত আসমানের ভাঁজের আড়াল থেকে রাবেয়া তাঁকে একলহমায় বের করে আনেন।
এবার আসে রাবেয়া বসরীর পালা- চকিতে রাবেয়া লুকান। হাসান বসরী তক্কেতক্কে নানা জায়গায় তালাশ করেন, ডানে-বাঁয়ে, উত্তরে- দক্ষিণে,পুবে-পশ্চিমে, আকাশে- পাতালে, স্বর্গে-মর্ত্যে- হেথায় খোঁজে, হোথায় খোঁজে তামাম বিশ্বজুড়ে; কিন্তু কোথাও রাবেয়া বসরী নেই।
হাসান বসরী হার মেনে চোখ বন্ধ করলে রাবেয়া পলকে বেরিয়ে এসে ঠিক রবীন্দ্রনাথ বুঝি বলেন- এতো দূরে দূরে কেন খোঁজো- আমি একদম কাছে, তোমার বুকের ভিতর আড়াল হয়ে ছিলাম- তোমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলাম- দেখতে আমায় পাওনি!

৩/০৯/২০
ফিলাডেলফিয়া

রাতজাগা কোমলগান্ধার
আমি জানতাম না- একজন মানুষের হাতের লেখা কীভাবে এতোটা পরিচ্ছন্ন গুটগুট হতে পারে। ওর হাতের লেখা ভীষণ পছন্দ করতাম, কিন্তু ওই হস্তাক্ষর আমার নমস্য ছিল না। আমার বিশ্বাস ছিল- কবিদের হাতের লেখা মানেই রবীন্দ্রনাথের হরফ, টি এস এলিয়টের হস্তাক্ষর- অবিন্যস্ত, ছেঁড়াখোড়া। তাই ও এমন গোছানো হাতের লেখা নিয়েও লজ্জা পেতো।

দাউদ আল হাফিজ
দাউদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে। আমি টেড হিউয়েজের কবিতা পড়ছিলাম, আমার সামনে টেড হিউয়েজ দেখে দাউদ নিজেই এসে খাতির করে: আপনি টেড হিউয়েজ পছন্দ করেন?

মাঝখানে একটু বলে রাখি- ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের একটা টাইপ আছে- সবাই সিলভিয়া প্লাথের অনুরাগী হবে, আর টেড হিউজের বিপক্ষে নানা প্রস্তুতি নিতে থাকবে; আত্মহননের কলকব্জাও নিজেদের অধিকারে রাখতে, বা এই বিষয়ে কথাটথা বলতে ভালোবাসবে। দাউদকে বলতাম- তুমি তো শৈলকূপার ছেলে, আবার ঝুলেটুলে পড়ো না যেন!

আমিও ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট শোনার পর পাঁচমিনিটে আমাদের একযুগের বন্ধুত্ব জমে ওঠে। দাউদ তখন বাঙলাদেশে রীতিমতো আতঙ্কজনক এক মেধাবী ছাত্রের নাম- অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও যশোর বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে দাউদ। দাউদের নাম বলে আমাদের মা-বাবারা আমাদের ধমকায়।
পরে প্রবাদপ্রতিম এই ছেলেটির সহপাঠী হয়ে আমাদের শিক্ষক, বন্ধু খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সঙ্গে যে কতো কাজ করেছি তার হিসাব অতি দীর্ঘ- ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে স্টাইলাস নামে দেয়াল ম্যাগাজিন করা, একবিংশ পত্রিকার সঙ্গে থাকা, জীবনানন্দ দাশ, সিমাস হেনি, ডেরেক ওয়ালকট, শামসুর রাহমান, বিনয় মজুমদার নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেওয়া তো আছেই।

আমার তখনও পড়াশোনার ঝোঁকটা ঠিক সাহিত্যপাঠের দিকে দাখিল ছিলো না। আমি পড়তাম- আনাতোলি লুনাচারস্কি, কার্ল মার্কস, কী রোজা লুক্সেমবার্গ, হাসান আজিজুল হক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর এই ধাঁচ। আর জড়িয়ে থাকি স্বৈরাচার ফেলানো আন্দোলনে, মধুর ক্যান্টিনে, রাজপথে।

দাউদ আমার নিরেট সাহিত্য পড়ার ঘাটতিটা বোধকরি পুষিয়ে দিতে চাইতো- টিএসসির ভিতর দেয়ালে হেলান দিয়ে দিনের পর দিন দাউদ আমাকে পড়ে শুনিয়েছে রবার্ট ফ্রস্ট, রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা, টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস, রশীদ করীমের আমার যত গ্লানি, বিরাম মুখোপাধ্যায়ের কবিতার বই নখে লাল, দাঁতে লাল।
একটা বিষয় ভীষণভাবে আমাকে এখনও ভাবায়- এতো যোগ্যতা থাকার পরও দাউদ সিম্পলি কিছু হতে চায়নি- ও কেবল কবি হতে চেয়েছিল; এটি একটি যুগের ধরন, আমাদের চোখের সামনে সময় অনেক চালাকচতুর, স্মার্ট হয়ে গ্যাছে- এমন আর কোনদিন দেখা যাবে না!

রবার্ট ফ্রস্টসহ আরো অনেকের লেখা অনুবাদ করেছিল দাউদ, আর মৌলিক কবিতার বই করেছিল- অনাবাস অথবা দ্বিধার গন্ধম; কতো কাঠখড় পুড়িয়ে আমার কাছে সুদূর এমেরিকায় এ-বই আমাকে পাঠিয়েছিল দাউদ!
দাউদ পিছনে পড়া মানুষ- পেশাগত জীবনে কিছু হয়নি- চোখের সামনে একে একে সব ট্রেন চলে গ্যাছে; কোন ট্রেনে ওঠেনি। অবশেষে একটি জবাফুল, একটি মোরগঝুঁটি, একটি মায়া তিমিমাছ, তমসা রাত্রির নাভিমূল ট্রেন দাউদকে নিয়ে গ্যাছে।
কিন্তু এখনো দাউদ আল হাফিজ কবিতাচূর্ণ একটি ট্রেনের ঘোরে শীতার্ত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে স্থির, একা!

৩০/০৬/২০
ফিলাডেলফিয়া

আগুনের নিচে পানিগাছ, হাওয়াকল, সারাদুনিয়া!

আগুন লাগে মেনিয়াপোলিস, লসএঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়ায়- শ্বাস নিতে পারে না, জর্জ ফ্লয়েড শ্বাস নিতে পারে না। শবযাত্রীদের দমবন্ধ লাগে! পানি দাও, পানি দাও- বাউবাব কাণ্ডে জমা ছিল জল; সে-ও নাচে রাস্তায় আগুনের সুষমা- আম্মাগো পানি দাও, ফেটে গেল ছাতিমা।

হাওয়াভরা দুনিয়ায় হাওয়া নিঃশেষ- রক্তে রক্তে গড়িয়ে পড়ে হাওয়ার দানা, গ্যালাক্সির কোটি তারকা ঝরকাবিহীন চোখ- অক্সিজেনের উনতায় ছিটকে পড়া আমাজন খাণ্ডবদাহনে চক্ষুহীন হরিণ।
পকেটে পকেটে জোনাকি জ্বলে- চোখের জলে গুহাচিত্র ঘোরে- ভিসুভিয়াস, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, ডেট্রয়েট, সাইক্লোন, অগ্নিমন্থন, ঘূর্ণিবায়ে ডুবে যায় ফিলাডেলফিয়ার লিবার্টি বেল।
গর্ভে সন্তান বাবা- জানালার পাটে বসা স্মৃতিপোড়া টিয়ার গ্যাস ও নীল এসফল্ট- কালো বিদ্যুৎ আর আদিবাসী দমকা হাওয়া- ওম সর্পগন্ধা, অর্জুন, জলপাই, ওম আমলকি, আকন্দ, বাসক, ঘৃতকুমারীর পাতা। ঘুম ঘুম, বেদের পাতা নিঙরে প্লাস্টিকের ব্যাগে সাত কিলো ঘুম!
কালের দোলানো আংটা - উনিশশো চৌদ্দ, সতেরো, উনচল্লিশ, তোপখানায় বাষট্টি, উনসত্তর, উনিশশো একাত্তর, নব্বই। যতোদূরে যাই- ভালোবেসে মা তুমি আগুন দাও কাকের পাখায়- দুনিয়ার এ-মাথা ও-মাথা উড়তে উড়তে যাই পাখা ভাঙা সুরমা গাঙের চাতক।
পানি কই, পানি কই- যে ছিল আমার আবে জমজম
সে-ই যে কেমন আগুনের বোন হয়ে নাচে!

২/০৬/২০
ফিলাডেলফিয়া

জন ওনাসিস
জন ওনাসিস আমার লাগোয়া প্রতিবেশী- গ্রীসের নামজাদা পরিবারের মানুষ। জে এফ কেনেডির স্ত্রী জেকুলিন কেনেডি ওনাসিস- তাঁর বংশের বধু, এর জন্য জনের মধ্যে একটা তোলা কাপড়ের মতো শ্লাঘা ছিল বৈকি! শেষের দিকে জন ওনাসিস অন্ধ হয়ে গিয়েছিল; একজন অন্ধ গ্রীক; আমি বলি: জন, তুমি তো কবি হোমার- আমাদের জমানায় এসে পড়েছো। জন বলতো- হয়তো, আমি হোমার, কিন্তু আমার হয়ে লেখো যে তুমি! আমি বলতাম- তথাস্তু।

জন একাএকা আর বাইরে যেতে পারতো না, তার স্ত্রী বেটি ওনাসিস ড্রাইভ করে নিয়ে যেতো। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে অন্ধ জন মিসেস বেটিকে বলতে থাকে রাস্তার কোন লেইনে তার থাকা নিরাপদ, কতোদূর গিয়ে কোথায় তাকে এক্সিট নিতে হবে। দোকানপাটে বেটিকে সে-ই হাতে বেড় দিয়ে রাখে! এর নাম কী- ভরসা, অধিকার, উদ্বেগ, না জন্মদাগের মতো অমোচনীয় এক লাবণ্য শীলা?
ঘরে ফিরেই জন আমার সংসার মাঝি নার্গিসকে ডাকে- নুফরি, নুফরি, বারান্দায় আসো গল্প করি, আমি বেটির বানানো বাখলাভা নিয়ে আসি। জন নার্গিস বলতে পারতো না, বলতো- নুফরি। নুফরি না-কী গ্রীসের একটি ফুলের নাম।
বসন্তে আমার ফুল ও পরাগের পোলেনে প্রচণ্ড এলার্জি- অসম্ভব হাঁচি হয়, আর চোখ জ্বালাপোড়া করে। আমি ঘরে জোরে হাঁচি দিলে জন ওনাসিস দেওয়ালের ওপার থেকে চেঁচিয়ে বলে- গড ব্লেস ইউ, গড ব্লেস ইউ। আমরা ঝমঝম করে হাসি, এটা ছিল আমাদের দুই প্রতিবেশী পরিবারের বসন্তকালীন খেলা।
জন চেঁচিয়ে বলতো- নুফরি, ডোন্ট গিভ আলমগীর এনি এলার্জি পিল, আই ডোন্ট সি এনিথিং, বাট আই লাইক দিস সাউন্ড।
এই নিদারুণ নিস্তরঙ্গ বসন্ত পোলেনের কালে আমার প্রতিদিন জন ওনাসিসের কথা মনে পড়ে। ভালো যে, এই অনাত্মীয় বসন্তে জন আর বেঁচে নেই। আমি হাঁচি দিলে জন নিশ্চয়ই বলতো- আমি ভয় পাই, নুফরি, টেইক হিম টু দ্য হসপিটাল! এই দৃশ্যটি কোনভাবেই ভাবতে পারি না।

আমি অকূল হয়ে সম্মিলিত একাকিত্বে জানালার পাশে বসে থাকি; সমস্ত যোগ্যতা খুইয়ে ফেলার পরেও অন্ধ জন ওনাসিসের ব্যাকুলতায় অবিরাম চেরি ফুলের দিকে নিথর অক্ষম অভিবাদন পৌঁছে দিতে মনের অজান্তেই বলি- ও চেরি ব্লোসোম, ওগো দখিন হাওয়া- আমাকে গ্রহণ করো, ক্ষমা দিয়ে দাও না আমার জীবন ধুয়ে!

বদরুজ্জামান আলমগীর
২৭/০৪/২০
ফিলাডেলফিয়া