ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Thursday, November 19, 2020

ঝিনুক ও সমুদ্রের গান।নভেলা সিরিজ।

।। ফারহিন চৌধুরী।।

পর্ব: ১০

🍀
সমুদ্রের পাড়ে ম্যাট বিছিয়ে সূর্য স্নানে ব্যস্ত মিলান ও ওল্যাণ্ড। রঙিন রোদচশমাটা আর সঙের মতো টুপিটা পরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুমোনোর ভান করছে মিলান।স্ট্রবেরী মিল্কশেকটা স্ট্র দিয়ে খেতে খেতে বিলাসিতার সমুদ্রে সাঁতার কাটছে দুজন।ক্যাফের জানালাটা দিয়ে এক কাপ গরম লেবুর চা খেতে খেতে সমুদ্রের নীরবতা উপলব্ধি করছে আমির।নারিকেল গাছের পাতা আর কাঠি দিয়ে চশমা বানাল সে আর সেটি চোখে লাগিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েছে।

মাজেদ রং তুলি আর পাতলা কাগজ নিয়ে মাটিতে বসে পড়ল।এমন সময়ে রমলা সেন অরণ্য সবুজ রঙের শাড়ির সাথে অঙ্কুষ সোনালী রঙের ঝুমকা পরে মাজেদের সামনে এসে দাঁড়াল।গতকালের নীললোহিত শাড়ি পরা রমলা সেন এখনো মাজেদের নোটবুক দখল করে বসে আছে।হাতের তপ্ত গোলাপী রঙের চুড়ির আওয়াজে মিষ্টি এক অনুভূতির স্বাদ মাজেদকে ছুঁয়ে গেল।চোখ দুটিকে রং তুলি আর কাগজের মধ্যে স্হির করল সে।রমলা সেন একটা চেয়ার টেনে মাজেদের উল্টো পাশে গিয়ে বসল।এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে গভীরভাবে মাজেদের দিকে তাকিয়ে রইল।

“ আপনি আমার ডায়েরির পরের পাতাটাও উল্টে দেখেছেন তাহলে ? “ “ হুম! নিন, আপনার পছন্দের রঙ দিয়ে ঘুড়ির ওপর মনের কথা লিখে ফেলুন।কথা প্যাচিয়ে লাভ নেই।ডায়েরির পাতাগুলো বাতাসের অশেষ কৃপায় স্লাইড শোয়ের মতো উল্টে গিয়েছিল।এর বেশি যথার্ততা আমার কাছে নেই।আসুন ঘুড়িগুলোর আকাশে ডানা মেলার পালা।” রমলা সেন সাদা রঙের ঘুড়িটির ওপর নীল রঙ দিয়ে “অপেক্ষা” লিখে ক্যাফের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন।মাজেদ মুচকি হাসি হেসে “ ঝিনুক” লিখা লাল রঙের ঘুড়ি আর নাটাই নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।শূণ্য সৈকতের মাঝে দুজনে ঘুড়ির লড়াইয়ে মেতে উঠল। “ তাহলে আপনার অনেকগুলো শখের একটি ছিল সমুদ্রের নিস্তব্ধতার মাঝে আকাশে নিজের বাহনটি চালানোর ! বাহ!” “ হুম।সেটাই।তবে আপনার জায়গায় নবণীতা মুখার্জির থাকার কথা ছিল।” “ তাই বলেই বোধহয় “অপেক্ষা” লিখলেন! “ “কিছু জিনিস মুখে প্রকাশ করা কঠিন।শব্দের আড়ালে সব সম্ভব।আজকের ক্যাপাচিনো আমি খাওয়াবো।এক্সপ্রেসো আসলেই আর ভাল লাগছেনা।” “ আমার তা হলে আজ ছুটি।” কথা বলতে বলতে রমলা সেন মাজেদের ঘুড়ি কেটে দিল আর অমনি হো হো করে হেসে পড়ল।আমির এই দৃশ্য দেখে মাটিতে লুটোপুটির অবস্হা।ঘুড়ি ওড়ানো শেষে দুজনে ক্যাফের সামনে এগোনোর সময়ে রমলা সেন ব্যাগের থেকে ডায়েরিটা বের করলেন। পেন্সিল দিয়ে দু নম্বর ইচ্ছেটা কেটে দিল।পাশে লিখে রাখল ~ মানুষটি বদলে গেছে!

ক্যাফের ভেতরে ওল্যাণ্ড ও মিলান তাদের অপেক্ষায় বসে ছিল।ওল্যাণ্ড বেশ ঋজু হয়ে চেয়ারে বসলেন। মাজেদকে লক্ষ্য করে একটি কথা বললেন। “ আপনার ক্যাফেতে প্যারিসের ক্যাফেগুলোর মতো ফ্রি পানি ও কিছু ব্যাগেট রাখতে পারেন। বেশ জমবে বিষয়টা।” ওল্যাণ্ডের সব কথা রমলা সেন মাজেদকে অনুবাদ করে দিচ্ছিলো আর এই প্রস্তাবটি শুনে মাজেদ বেশ আনন্দিত হলো। একেক দেশের একেক সংস্কৃতি তবে আপন করে নিতে ক্ষতি কি।এইবার চটপট করে মাজেদ ওল্যাণ্ডকে কিচেনে নিয়ে ব্যাগেট শিখে ফেলল।বলাবাহুল্য যে আজকের খাবারও ফ্রি। মুনির চাচার ব্যবসা লাটে উঠেছে ।

🍀পর্ব:১১

রাতের প্রায় আটটা বাজে। ক্যাফেতে রমলা সেন জানালার পাশের টেবিলটাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে।এক কাপ গ্রীন টি আর সাথে টোস্ট বিস্কুট খেতে খেতে রোজনামচা লিখছে। মাজেদ কিচেন কাউন্টার ক্লিনিঙে ব্যস্ত।আজ বহু দিন বাদে রিসোর্টের ম্যানেজার অরবিন্দু বাবু তার ভায়োলিন বাজাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে রমলা সেন কলমটা মাথায় আটকে বেশ চিন্তিতভাবে ভায়োলিনের নোট বদলানোর অনুরোধ জানাচ্ছেন।রিসোর্টের কয়েকটা পর্যটক ছাড়া ক্যাফে প্রায় ফাঁকা।আজ সকালবেলায় মিলান রমলা সেনকে একটা ফরাসি নাম দিয়েছে- “মা বেল” যার অর্থ “ আমার সুন্দরী”। রমলা সেন নামটা পেয়ে বেশ খুশি।কাগজ দিয়ে কিছু রঙিন ফুল আর নৌকা বানিয়ে মিলানকে উপহার দিয়েছে।উপহারগুলো পেয়ে মিলান বেশ খুশী হয়েছিল। রমলা সেনের ডায়েরিতে একটা নোট লিখেছে - “জো তেম বকু, পাহি তা’ডন্ড” ~ তোমায় অনেক ভালবাসি, প্যারিস তোমার অপেক্ষায় রইল। বিদায় বেশ কঠিন! অল্প সময়ে কাছে এসে দূরে চলে যাওয়া বেশ কষ্টের।আঘাতটা মনের গভীরে সহজেই থেকে যায়।

আমির ক্যাফের বাইরে টুলটাতে বসে মাথা নীচু করে বেশ কান্না করছে। হাতে কয়েকটা ঝিনুক আর টুলের পাশে একটা প্লেটে ডাবের সাস দিয়ে পুডিং বানিয়ে রেখেছে। পুডিংটা দেখতে নীল, এক রকমের রং মিশিয়েছে সৌন্দর্যের জন্য। মাজেদ বাইরে এসে আমিরের মাথায় হাত বোলালো আর একটু শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা। ক্যাফের সামনে একটা ট্যুরিস্ট বাস দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার একটু পর পর গাড়ির পেছনে লাগেজ উঠাচ্ছে। এমন সময়ে মিলান দৌঁড়ে এসে মাজেদকে আলিঙ্গন করল। দুজনের চোখে পানি আর মুখে বেদনাদায়ক বিচ্ছেদের হাসি।মিলান আমিরকে তার রোদচশমাটা খুলে চোখে পরিয়ে দিল। সেদিন আমিরের সেই নারিকেল পাতার চশমাটা দেখেছিল আর চশমার প্রতি আমিরের শখটাও বুঝতে পেরেছিল।আমির মিলানকে তার নীল ডাবের পুডিং খাইয়ে দিল আর সাথে ঝিনুকের তৈরি কিছু মালা আর বাক্স উপহার দিল।বন্ধুত্বটা যেন স্মৃতির বিনিময়ে আগলে রাখা। মাইলের পর মাইল দূরে থেকেও অনেক কাছে থাকা। ওল্যাণ্ড রমলা সেন ও মাজেদের থেকে বিদায় নিল আর সাথে তুলে ফেলল গ্রুপ ফটো। এইবার ব্যাকগ্রাউন্ড “ ঝিনুক ক্যাফে” আর ক্যাপশন “ লো হেসতোহো ডু ক্যাফে দো লা মেহ” ~ সমুদ্রের কফি শপ ।চোখের পলকে সময়টা চলে গেল । মিলান চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে আমিরের দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো হাত নেড়ে বিদায় জানাল।

ঠিক তখন রাতের আকাশে কিছু অজানা ফানুস ভেসে চলেছে যেন তাদেরই একটিতে আমির আর মিলানের কিছু গোপন কথা লিখে উড়িয়ে দিয়েছে কেউ ! রমলা সেন ফানুসগুলোর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল, একটি ফানুসে লেখা “ স্বপ্ন” !

মাজেদের দিকে তাকিয়ে ডায়েরির পরের পৃষ্ঠায় “রাতের আকাশে স্বপ্নের ফানুস” লিখা লাইনটা কেটে দিল। পাশে লিখে রাখল , “ভাবতে পারিনি এভাবে আমাকে না বলে কালো আকাশে মোমবাতির আলোর মতো উড়ে বেড়াবে! মাজেদ রমলা সেনের দিকে মুচকি হেসে ক্যাফের ভেতর চলে গেল।

ফারহিন চৌধুরী
১৫/০৫/২০
ঢাকা




ছবি, তারিক আদনান মুন