ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Monday, January 11, 2021

এই শহরের হাওয়া বিবি এবং আবদ্ধ আলিঙ্গনের গল্প

।।২২তম নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনী- ২০২০, ঢাকা।।


দিলরুবা পাপিয়ার জার্নাল :

গত ২৮ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমিতে "২২ তম নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনী- ২০২০" দেখতে গিয়েছিলাম।একাডেমির গেইটে নেমে অভ্যাস অনুযায়ী, চারুকলার ছাত্র- ছাত্রীদের এই অভ্যাসটি বোধ হয় একটু বেশি, প্রথমেই গেইটের সাজসজ্জার ছবি তুলে নিলাম।

গেইটের বাইরে থেকেই আমি অনেক নবীনদের ভিড় দেখছিলাম! এবং বেশ লম্বা লাইনও আছে। আঁকাবাঁকা হয়ে কোন্ পর্যন্ত গিয়েছে তা দেখা যায় না, আমি চেষ্টাও করছি না। ভাবলাম এতো নবীনের পদচারণা, নিশ্চয়ই ওদের কোনো অনুষ্ঠান আছে। আমি এদিক সেদিক ছবি তুলছি আর আমাদের চারুকলার স্টুডেন্টদের জন্য অপেক্ষা করছি। ওদের কয়েকজন আসার কথা। ওরা আসলে একসাথে গ্যালারীতে যাবো। এতো উচ্ছল তরুণ-তরুণী, শত শত! সেলফি তুলছে! হৈচৈ করছে! ঠেলাঠেলি করছে! হাসি তামাশা করছে! আমি রীতিমতো ঘাবড়ে যাচ্ছি! কি জিজ্ঞেস করবো? কি বললে বোকা বোকা প্রশ্ন হবে না!

আমি পাশেই হাঁটাহাঁটি করছি। শেষমেশ জিজ্ঞেস করলাম; এই লাইনটা কোন্ প্রোগ্রামে যাচ্ছে? পর পর দুজনই আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। কোনো উত্তর দিলো না। একটু এগিয়ে আরএকজনকে বললাম, সে জানালো আর্ট গ্যালারীতে। আমি যেন ধপাস করে পড়লাম! মানে কি? কেন? যেন এভাবে আসতে মানা! আগে কখনও আমি এমনটা দেখিনি তো! শত শত মানুষ চিত্র প্রদর্শনী দেখার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো এখনকার তরুণ-তরুণীরা হঠাৎ এভাবেই জমে যায়! যেমন শাহবাগ আন্দোলনে জমেছে! যেমন কোটা আন্দোলনে জমেছে! যেমন নিরাপদ সড়ক চাই-এ স্কুলের শিশুরাও জমেছে! ওরা পুলিশের মারধোর, জেলজুলুমও সহ্য করেছে! যা আমাদেরকে আশ্চর্য করে দিয়েছে।

তবে এই জমায়েত কভিডের হাঁপিয়ে উঠা জমায়েত। ঢাকা শহরে বিনোদন বিহীনতার জমায়েত। কোথাও নিঃশ্বাস নেয়ার জমায়েত। যে কারণেই হোক আমি এই জমায়েতকে খুবই পজেটিভ ভাবে নিয়েছি। আমি উদ্বেলিত হয়েছি!যাক্! কোথা থেকে কোথায় চলে গেলাম! শেষে ভয়ে ভয়ে সবার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একদম মূল ফটকের সামনে থেকে। এই করে গ্যালারীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলে গেলো।

ভালো লেগেছে শিল্পকলা একাডেমির নতুন সংযোজন "কিউরেটরিয়াল প্রজেক্ট"! ব্যক্তিগত ভাবে শিল্পকর্ম দেয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলাদা ভাবে জায়গা দেয়া। যেখানে তারা নিজেদের সৃষ্টিশীলতার ছাপ রাখতে পারবে। সেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও কম যায়নি। তাদেরও কারো কারো এই গ্রুপ ওয়ার্কটি তাৎপর্যপূর্ণ করার যথেষ্ট চেষ্টা ছিলো দেখলাম

এই প্রজেক্ট বা গ্যালারীগুলোতেই ছিলো তরুণদের উপচে পড়া ভিড়। ওরা কেউ কেউ ছবি দেখছে বটে, তবে তার চেয়েও বেশি কলরব করছে। একটা বিষয় মনে হলো, ছবি দেখারও একটা তাসির আছে। এই বিষয়টি আমরা তাদেরকে শিখাতে পারিনি। মনে হলো ছোটবেলা বা বড়বেলায় কখনো তারা বাবা- মা বা স্কুল থেকেও কোনো গ্যালারীতে আসেনি। আমাদের দেশের স্কুলগুলো এসব কিছুই শেখায় না। তাদের কারিকুলামে এসব নেই। বাইরের দেশে স্কুল থেকেই নিয়ে যায়। তারা কিভাবে লাইব্রেরী ব্যবহার করবে, কিভাবে রাস্তা পারাপার হবে, কিভাবে একজন প্রতিবন্ধীকে সহযোগিতা করবে? এমন অনেক কিছু তারা প্রাইমারীতেই শিখে যায়। তাই এখানে ওরা কোনো নিয়ম মানছে না। শিল্পকর্মগুলোকে যেমন খুশি তেমন করে ব্যবহার করে তারা ছবি তুলছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। এলাহি কাণ্ড!

প্রতিকৃতি।মো, ছামীন ইয়াছার।


আমার সামনেই একটি ভাষ্কর্য তার বেদীসহ ছিটকে পড়ে গেলো। আমার বুকের মধ্যে লাগলো। দৌড়ে গেলাম! দেখলাম কোথাও কিছু ক্ষত হয়েছে কি না! দেখলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছামিন শুভ- র করা ভাষ্কর্য!ভাষ্কর্য আরও ছিলো। কিন্তু অস্থির তরুণরা আমার মোবাইল ছিটকে ফেলে দিয়েছে।পরে আর ফোন কাজ করেনি। ছবি তুলতে পারিনি।

খোদ শিল্পকলা একাডেমিতে শিল্পকর্মের এই অবস্থা! গ্যালারীতে কিছু জায়গা পরপরই একজন প্রত্যবেক্ষণকারী আছেন। তারা জানালো, যথেষ্ট বলছে কিন্তু কেউ তাদের কথা শুনছে না। এখন আপনিই বলেন, ওদের কি লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা!ওরা নিচেই চিত্রশালার বিল্ডিং-এ ঢুকার সময়ই প্রত্যেকের মাস্ক নিশ্চিত হয়ে ঢুকতে দিয়েছে। কিন্তু ভিতরে অনেকেই খুলেছে। ভিতরে ওরা দেখার সাথে সাথেই বলেছে।

দিলরুবা পাপিয়া


শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।ভাস্কর্য।মোজাহিদুর রহমান সরকার।



এই শহরের হাওয়া বিবি।শৈলী শ্রাবন্তী

''''বোরকা পরিহিতা নারী বর্তমানে আমাদের আমাদের সমাজের একটি পরিচিত চিত্র।মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হ হওয়ায় এই পোষাকটি বেশ প্রচলিত।সময়ের পরিক্রমায় পোষাকটি অনেক নারীরই নিত্যসঙ্গী হয়েছে।কখনো ধর্মের কারণে, কখনো আভিজাত্যের প্রতীক, কখনো দারিদ্র লুকাতে, কখনো নির্দিষ্ট পেশার ক্ষেত্রেও এ পোষাকটি নারীরা ব্যাবহার করে থাকেন।এই শহরে আছে হাজার হাজার বোরকা পরিহিত নারী।নানা রঙ এর, নানা ধরনের এই পোষাকের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এইসব নারীদের গল্প।জীবন ও জীবিকার তাগিদে শহরে টিকে থাকা এইসব নারীদের একেকজনের কাছে শহরটা একেক রকম।কারো কাছে শহরটা লাল, নীল রঙের স্বপ্নের মতো, কারো কাছে আটকে পড়া বেদনা, কারো কাছে তারুণ্যের উচ্ছলতা, কারো কাছে সব বাধা বিপত্তি ভেঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।পর্দার আড়ালে থাকা এইসব নারীদের অনুভূতিগূলোও আড়ালেই থেকে যায়, তাদের সংগ্রাম, আশা, ভালোবাসা, সবকিছু ঢেকে থাকে তাদের পোষাকের আড়ালে।এই শহরের হাওয়া বিবি সিরিজ এই সকল নারীদের গল্প তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র, যারা শারিরীক, মানসিক নির্যাতন সহ্য করেও জীবন ও জীবিকার তাগিদে এই শহরে আটকে থাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে, ঠিক যেমন আদি মাতা হাওয়া মাথায় নিষেধাজ্ঞার দায় নিয়ে সংগ্রামী প্রত্যয়ে পৃথিবীতে টিকে ছিলেন।''শৈলী শ্রাবন্তী*

নুরু মিয়ার গল্প।আল মঞ্জুর এলাহী।


শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।মৃৎশিল্প।তানভীর হোসেন রিদম।


প্রতিবিম্ব।ইফফাত জাহান।
বর্তমান সময় বিবেচনায়।জয় কর্মকার।


আবদ্ধ আলিংগন।নিশাত মীম সাকিন।
''আবদ্ধ আলিঙ্গন শিল্পকর্মটি এমন একটি বিষয় নিয়ে চিত্রিত হয়েছে যা একজন নারী যুগের পর যুগ ধরে তার নিজের সঙ্গে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।এ যেন এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।যুগ পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু মানুষের চিন্তা করার অভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে না।তারা কেবলই ভাবে নারী  মানেই আরেকজনের দাসত্ব।আর নারীদের বিয়ে মানেই তোমার স্বাধীনতা কতটুকু হবে তা পরিমাপ করবে আরেকজন।আমরা ভুলে যাই নারীরাও মানুষ।নারী তার নিজের ইচ্ছেগুলোকে পুরণ করার অধিকার রাখে।বিয়ে করে নিজের সবকিছু বিসর্জন দেয়ার মানেই কি বিয়ে?

আমার শিল্পকর্মটিতে এখানে ময়ুরকে এক নারীর সাথেই তুলনা করেছি।ময়ুরকে আমার খুব নিরিহ মনে হয় এবং দেখতে সুন্দর ও উপভোগ করার মত।একে পায়ে শিকল দিলে ওর ছুটে আসার কোনো উপায় নেই।আমার মনে হয় নারীরাও তাই।বিয়ে নামক এক আবদ্ধ আলিঙ্গনে জড়াচ্ছে কিন্তু ছুটে আসার উপায় নেই।''নিশাত মীম সাকিন*
তরঙ্গ বিতর্ক : গর্ভপাতের ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা :  

চয়েসের প্রসঙ্গে নারীর গর্ভপাতের অধিকার, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবিধান-সম্মত অধিকার।বিভিন্ন ধর্মের মৌলবাদীরা নারীর অধিকারকে সমর্থন করে না এবং নারীকে ে প্রসঙ্গে অপরাধী বানিয়ে কাঠগড়াতে দাড় করাতে চায়।পুরুষ গর্ভ ধারণ করে না, কিন্তু নারীর গর্ভ ধারণ প্রক্রিয়া ও গর্ভপাত বিষয়ে নিতি নির্ধারণ করে থাকে, আবার বহু নারীও পুরুষের এহেন তৎপরতাকে সমর্থন করে থাকে।জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দেশের সাংবিধানিক আইনে নারীর গর্ভপাতের অধিকারকে মানবিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।আবার অনেক দেশে স্বীকৃতি দেয়া হয় নাই।অনেক দেশে স্বীকৃতি দিয়ে প্রত্যাহা করে নেয়া হয়েছে, য্যামন পোল্যান্ডে, যেখানে বিপুল সংখ্যক নারী, পুরুষ এই প্রত্যাহার আইনের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন বিক্ষোভ করেছে।
সোসাইটি এন্ড এ্যাবর্শন।খাদিজাতুন নোমানী।

নারীর চয়েসের অধিকার খর্বের পেছনে ধর্মিও সংঘগুলোর সরাসরি হাত আছে।বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী সংগঠনগুলো ফতোয়া জারী ও প্রচারের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে।অনেক সময় এন্থ্রোপলজির চৌকশ অধ্যাপকেরা প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক চলকে সাংস্কৃতিক পরিচয় বলে প্রতিষ্ঠিত করছে।বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নবীন শিল্পীদের প্রদর্শনীতে এরকম একটি চৌকশ ফতোয়া উপস্থাপন করা হয়েছে, স্টপ মার্ডার শিরোনামে।এ কাজটির একটি ক্যানভাসে দেখানো হয়েছে গর্ভপাতের সিরিঞ্জ, রক্তাক্ত কাপড়, আরেকটিতে একটি কাচের বোতল থেকে ভ্রূণ ঘুষি মেরে বেরিয়ে আসছে।এ-দুটি কাজের শিল্পী খাদিজাতুন নোমানী গর্ভপাতে জড়িতদের হত্যাকারী বলছেন।বাংলাদেশের সংবিধানে গর্ভপাতকারিনী এবং প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতদের হত্যাকারী বলা হয় না।শিল্পী, তার বিশ্বাস ব্রোশিয়ারে দুর্বল ইংরেজিতে তুলে ধরেছেন।

বিশ্বাস এক জিনিস, আর অধিকার আরেক জিনিস।গর্ভপাতের অধিকারের পেছনে রয়েছে, নারীর শরীর যে তার শরীর এবং শরীরকেন্দ্রীক অধিকারগুলো একান্তভাবে তার সে প্রবর্তনাটি প্রতিষ্ঠিত করা।নারী শরীর যে শিশু উৎপাদনের কারখানা নয় সেটাও গর্ভপাত অধিকারের পেছনে কাজ করছে,  যেখানে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে যে নারী শরীর ও মনের মালিক সে নিজে, তার শরীর ও মনের  মালিক সমাজ, পরিবার, পুরুষ বা রাষ্ট্র নয়।অনেক সময় গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্যগত প্রয়োজনে গর্ভপাত করা হয়।ধর্ষণের কারণে অনেক সময় গর্ভপাত করা হয়।অপরিকল্পিত, অনভিপ্রেত গর্ভ ধারণ থেকে অনেক সময় গর্ভপাত করা হয়।ইতিহাসে বার বার পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক হারে নারীদের ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে।পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের হাতে এরকম ঘটেছে ১৯৭১ সালে।

গর্ভপাতের পর নারীকে যাতে সামাজিকভাবে হ্যানস্থা না করা হয়, অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে না দেয়া হয়, নারী যাতে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গর্ভপাত করতে পারে তা নিশ্চিত করতে অনেক রাষ্ট্র ধর্মের বিধান পার হয়ে নারীর গর্ভপাতের অধিকার বা চয়েস সাংবিধানিক আইন করেছে।শিল্পকলার নবীন শিল্পী প্রদর্শনীতে গর্ভপাত বিরোধী দুটো কাজে এবং তাদের আনুষঙ্গিক বিবৃতিতে নারী অধিকারের মূল জায়গাটির বিরোধিতা করা হয়েছে যা রক্ষণশীলতার মানদণ্ডে মৌলবাদকে প্রতিষ্ঠিত করবার একটি পুরনো কৌশল।

ইংরেজি সবল বা নির্ভুল হলে যে ইস্যুটা প্রতিক্রিয়াশীল পোস্টারের ভাষার বাইরে চলে আসতো তা নয়।পশ্চিমে খ্রিস্টান মৌলবাদীরা নিয়মিত বিপুল খরচ করে এসব ধরনের ছবি দিয়ে প্রোপাগান্ডা চালায়।শিল্পকলা একাডেমি তাদের সমষ্টি প্রদর্শনীতে অবশ্যই মিডিয়াম, মনন ও মতামতের বিচিত্রতা তুলে ধরবে।এ প্রদর্শনী সেদিক থেকে সফল।কিন্তু কোনো মতামত বা কাজ যদি অন্যের অধিকার খর্ব করে বা হুমকি তৈরি করে তাকে বিদ্বেষপ্রসূত উস্কানি বলা যেতে পারে। 

তরঙ্গ লোকনকাঁচ :  কিউরেটোরিয়াল প্রকল্প :

কিউরেটরিয়াল প্রকল্পগুলোর যথার্থ প্রশংসা করেছে দিলরুবা পাপিয়া।তবে কিউরেটরদের মনে রাখতে হবে তারা একজন বা কয়েকজন শিল্পিকে একটা থিমের মাধ্যমে উপস্থাপনা করছে, কিউরেটর হিশেবে নিজের উপস্থাপনা নয়।কিউরেটেড প্রত্যেকটি শিল্পকর্মে শিল্পীর স্বাক্ষর থাকা জরুরি।তা নাহলে কপিরাইট প্রবর্তনার মূল স্তম্ভ লঙ্ঘিত হয়।কিউরেটিং ব্যাপারটি ঢাকাতে নূতন এবং বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা বা অপব্যাক্ষা করা হচ্ছে।ধরা যাক কলাকেন্দ্রের কথা, এখানকার প্রদর্শনীগুলোর ব্রোশিয়ারে কাঁকুরের চেয়ে বিচি অর্থাৎ কিউরেটর ওয়াকিলুর রহমানের নাম বেশী লম্বা হয়ে ঝুলে থাকে।স্থানীয় আর্ট ক্রিটিকেরাও ব্যাপারটাকে খামাখা জটিল করে ফেলছেন।


কিউরেটরিয়াল প্রকল্পের অংশ।তামজিদ নওরিন পূর্ণি।

কিউরেটর হচ্ছে সাহিত্য সঙ্কলনের সম্পাদকের মতো, সে সঙ্কলনে নবীন বা প্রবীণ সব লেখকের নাম অবশ্যই দিতে হবে।কিউরেটর, সম্পাদক, অনুবাদকদের নিয়ে আমাদের ধারনা দিনকে দিন দুর্বল হচ্ছে কপিরাইটকে প্রতিষ্ঠা করবার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার কারণে।এ-ক্ষেত্রে মনে পড়ে যাচ্ছে কয়েক বছর আগে ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত ভালো মঞ্চ প্রযোজনা টুয়েলভ এংরি ম্যানের কথা।অনুবাদ, নির্দেশনা, অভিনয় সব ভালো, ব্রোশিয়ারে সবার নাম আছে কিন্তু অনুবাদকের নাম নেই।মঞ্চায়নের প্রথম দিনও নাটকটি মঞ্চায়নে জড়িত অধ্যাপক আব্দুস সেলিম অনুবাদকের 
নাম স্পষ্ট করেন নাই।হতে পারে যে নাটকটি একজন ছাত্র অনুবাদ করেছে, তাকে ক্রেডিট দেয়া হয় নাই।এরকম একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ১৯৯০ সালে চয়ন খায়রুল হাবীবের অনুদিত ওলে সোয়িঙ্কার নাটক রক্তবীজ নিয়ে।নাটকটি মঞ্চায়নের পর পর আবিদ আজাদ শিল্পতরু থেকে তা প্রকাশ করে অনুবাদকের কপিরাইট নিশ্চিত করেন।ধান ভানতে শিবের গীত অনেক সময় দরকারি।যে দেশে প্রকাশনা শিল্প দাঁড়িয়ে আছে পাইরেসির ওপর, গীতিকাররা জেলদন্ড খেটেও নির্লজ্জভাবে বুক ফুলিয়ে গানের বানী চুরি করছে, শিক্ষকেরা গবেষনা প্লাজিয়ারাইজ করছে সেখানে কিউরেটরিয়াল প্রকল্পের দোহাই পেড়ে শিল্পীদের স্বাক্ষর এড়ানো একেবারে অনুচিত কাজ।

কিউরেটর হচ্ছে সাহিত্য সঙ্কলনের সম্পাদকের মতো, সে সঙ্কলনে নবীন বা প্রবীণ সব লেখকের নাম অবশ্যই দিতে হবে।কিউরেটর, সম্পাদক, অনুবাদকদের নিয়ে আমাদের ধারনা দিনকে দিন দুর্বল হচ্ছে কপিরাইটকে প্রতিষ্ঠা করবার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার কারণে।


কিউরেটরিয়াল প্রকল্পের অংশ।জেসমিন আখতার সুমি।

তরঙ্গ পুনশ্চ :

কোভিড অতিমারির চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির ভেতর শিল্পকলা একাডেমির চিত্রকলা বিভাগ এ আয়োজন করেছে।কিছুদিন আগে সৈয়দা মিনি করিম এ বিভাগের পরিচালনার দায়িত্ব পান।বাংলাদেশের শিল্প, সংস্কৃতির নীতি নির্ধারনী পদে নারীমুখ বিরল।দায়িত্ব গ্রহণের স্বল্পকালের ভেতর এরকম একটি প্রাণচঞ্চল প্রদর্শনী উপহার দিয়ে মিনি করিম আমাদের ধন্যবাদার্হ।দিলরুবা পাপিয়ার লেখা থেকে আমরা জানছি, কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা স্বত্বেও সার্বক্ষণিক মাস্ক পরিধান সবসময় বলবত থাকে নাই।স্বাস্থ্যস্মমত দূরত্ব বজায় থাকে নাই।নির্দিষ্ট সংখ্যককে ঢুকতে দিয়ে, বেধে দেয়া সময় থাকতে দিয়ে, ব্যাচ করে ঢোকালে কিছুটা সামাল দেয়া যেতো।এখান থেকে বই মেলাতে আগাম প্রস্তুতি না নিলে সংক্রমণের কি পরিস্থিতি হবে তা অনুমেয়।বইমেলাতে কি সিগারেট ফোকা নিষিদ্ধ করা হবে?সিগারেটের প্যাসিভ ধোয়া থেকে যদি অন্যদের শ্বাসকষ্ট হয়, তাহলে যেসব ধূমপায়ী কোভিডে আক্রান্ত, কিন্তু নির্ণীত নয়, তারা নিঃসন্দেহে অতিমারির পরিধি বাড়াবে।

শিল্পকলার প্রদর্শনীর গুনগত মান ও সামাজিক বিশ্লেষণে ফেরা যাক।মিনি করিম স্নাতকোত্তর বাংলাদেশের চারুকলা ইন্সটিউটে, উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নামি চারুকলা বিদ্যাপীঠে, দেখেছেন অনেক।পূর্বে ও পশ্চিমে নারীদের প্রতিনিধিত্বের বাধাগুলো নিশ্চিতভাবে উনি জানেন।বাংলাদেশে ফ্যাকাল্টি পর্যায় থেকে ছাত্রদের আনুপাতিক হিশেবেও জেন্ডার বা লৈঙ্গিক প্রতিনিধিত্বের ভারসাম্য এখনো আসে নাই।বর্তমান প্রদর্শনীতে মেয়েদের কাছ থেকে ফর্ম, মিডিয়াম ও ইস্যুর দিক থেকে আমরা বেশ কিছু মানোত্তির্ন কাজ পেয়েছি।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে মানোত্তির্ন শিল্পের ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক তর্ক প্রযোজ্য কি না?বিশ্বের সব প্রান্তে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধার্মিক, সাংস্কৃতিক, অধিকারগত সব ধরনের আলোচনায় লৈঙ্গিক বা জেন্ডার প্রতিনিধিত্ব জায়গা করে নিয়েছে।মি টু আন্দোলনে স্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীদের অনেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ মানের শিল্পী।বাংলাদেশে লৈঙ্গিক প্রতিনিধিত্ব তথা নারী অধিকার আন্দোলন বাস্তবতা  এবং প্রবর্তনা উভয় দিকে অত্যন্ত দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।বর্তমান প্রদর্শনীতে নারী শিল্পীদের বিষয়গত বিতর্কে তা উঠে এসেছে।আশা করা যায় অবদমন, আবদ্ধতার শৃঙ্খল নিয়ে সচেতনতার পাশাপাশি নবীন শিল্পীদের অনেকে নারী ও পুরুষের দৈহিক, মানসিক উল্লাস ও চয়েসের উন্মোচনে, যৌনায়নে সাহসী হয়ে উঠবে।আশার বিশয় যে উপস্থাপনাতে এরা কেউ বিমূর্ত নয়।বাংলাদেশে মূর্তি ও ভাস্কর্যের পার্থক্য নিয়ে বিধ্বংসী, প্রতিক্রিয়াশীল কুতর্কজাত আশঙ্কার পরও আশা জেগে থাকে!

প্রদর্শনীতে নবীন শিল্পিদের হাত থেকে যে ধরনের কাজ এসেছে, তাতে ফর্মের দিক থেকে যেরকম, সেরকম সামাজিক ইস্যু ও ব্যাক্তিক লৈংগিকতার ক্ষেত্রে মননশীল আলোচনার পরিসর তৈরি হয়েছে। ।সংগঠকদের আমরা ধন্যবাদ জানাই।  
   

সম্পদনা
নাসরিন-জয়া হক/তরঙ্গ


টেক্সট, দিলরুবা পাপিয়ার অংশ সরাসরি প্রাপ্তি।
*শৈলী শ্রাবন্তী ও নিশাত মীম সাকিনের অংশ শিল্পকলা একাডেমি প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম বর্ণনা থেকে।লেখার শিরোনাম নেয়া হয়েছে এ-দুজন শিল্পীর কাজের নাম থেকে।
ফটো সৌজন্য, দিলরুবা পাপিয়া