ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, March 5, 2021

বোর্হেসিয়ান ধাঁধা : বাংলায় স্প্যানিশ সাহিত্যের অনুবাদ প্রসঙ্গে

।।নাসরিন-জয়া হক।।

বুয়েনস আইরেসে হোর্হে লুইস বোর্হেসের ভাস্কর্য।ভাস্কর, গ্যাব্রিয়েল  সোজি।

জুলেখা সিরাপে খায়রুল আলম চৌধুরীর প্রশ্নে ইশরাত তানিয়া ওনার আলোচনার সূত্রে জানিয়েছেন, 'বোর্হেসের ইংরেজি অনুবাদ পড়াই ভালো। বাংলায় রাজু আলাউদ্দিনের অনুবাদ, আর মনোজ চাকলাদার সম্পাদিত অনুবাদ পাওয়া যায়৷ বাংলার পাশাপাশি একই গল্পের ইংরেজি অনুবাদ পড়ার অনুরোধ।'

এটা কেনো হয়? একজন দুটো ভাষা জানেন, অথচ তার অনুবাদ জমে ওঠে না, রসজ্ঞতার মানদণ্ডে উৎরায় না!জিমেনেজ  রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী স্প্যানিশে অনুবাদ করেছিলেন বাংলা না জেনে, ইংরেজি থেকে। জিমেনেজের তিন ভাগের এক ভাগ মৌলিক লেখা রবীন্দ্রনাথ থেকে অনুদিত। জিমেনেজের গীতাঞ্জলি অনুবাদে কিশোর নেরুদা মাতোয়ারা হয়ে গেছিলেন।নেরুদার প্রথম কবিতা সংগ্রহ কুড়িটি প্রেমের কবিতা এবং একটি বিষণ্ণ গানের  একটি কবিতা রবীন্দ্রনাথের 'তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা'  গানটির হুবহু অনুবাদ। ১৯২১ সালে বোর্হেস আলট্রা সাহিত্য আন্দোলনের পত্রিকায় লা মেটাফোরা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রথম উল্লেখ করেন।১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ বুয়েনস আইরেসে এসে পৌঁছলে বোর্হেস প্রবল উৎসাহ নিয়ে আরেকটি সাহিত্য পাতায় তার লেখার শিরোনাম দিয়েছিলেন, 'রবীন্দ্রনাথের আগমন'। ওক্তাভিও পাজ লিখেছেন, ''আমাদের অনেক লেখক রবীন্দ্রনাথে প্রভাবিত, কিন্তু আমাদের কোনো কবি ও লেখক তাকে প্রভাবিত করতে পারে নি।রবীন্দ্রনাথ স্প্যানিশ ভালো করে জানতেন না, স্প্যানিশ ভাষার লেখালেখি ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় আছে বলেও ওনার লেখাতে কোনো প্রমাণ মেলে  না।'' 

বোর্হেস ও আর্নেস্টো সাবাতো
চয়ন খায়রুল হাবিব নেরুদার ইল পোস্তিনো পুরো অনুবাদ করেছেন স্প্যানিশ না জেনে। মূল স্প্যানিশ ও ইংরেজি অনুবাদগুলো পড়বার পরও আমার চয়নের অনুবাদ ভালো লেগেছে, যেরকম ওনার সোয়িঙ্কা অনুবাদ ভালো লেগেছে। এটা কেনো হয়?একজনের আসলে প্রথমে নিজের ভাষার সঙ্গীতে, কবিতায় এবং অভিব্যাক্তিজাত অন্যান্য শিল্পের স্বরলিপি থেকে বিচিত্র প্রকাশভঙ্গী বা মাল্টাই জনরা মাধ্যমে ভালো দখল থাকতে হয়।লুই মাল তার ফ্যান্টম ইন্ডিয়াতে ভারতকে যত ভালোভাবে ধারণ করেছেন, অনেক ভারতীয় তা এখনো করে উঠতে পারেন নাই।অথচ লুই মাল ভারতীয় কোনো ভাষা জানতেন না।

বাংলাদেশে আধুনিক ভাষা ইন্সটিউটের স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক রফিকুম মুনির চৌধুরী স্প্যানিশ ভাষা থেকে বাংলাতে অনুবাদ করেন, একটি অনুবাদের পত্রিকা চালান, রাজু আলাউদ্দিনের নাম এখানে, সেখানে প্রচুর দেখা যায়।দুজনেই স্প্যানিশ ভাষা জানেন।রফিক লন্ডনের সোআসে/SOAS আমাদের কিছু জুনিয়ার, পড়াশোনাতে নিঃসন্দেহে খেটেছেন।ওনার সম্পাদিত অনুদিত পত্রিকার লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে, বাংলা ও স্প্যানিশ ভাষার রস, সঙ্গীত, লাবণ্য, দৃঢ়তা, কামজতা উনি এবং ওনার সঙ্কলিত অনুবাদকেরা ধরতে পারেন নাই।একই কথা মনে হয়েছে রাজুর অনুবাদের কয়েক পৃষ্ঠা উলটে পাল্টে।মেক্সিকোকে মোহিকো, মেহিকো করার মধ্যে নভেলটি, কেরদানি, ওপর চালাকি সবই আছে, কিন্তু ক্রাফটিনেস পেরিয়ে মাধুর্য এবং দেহসংলগ্নতার উচাটনটুকু নেই, নিজের ভাষার প্রাপ্তি ও সমকালীন নবায়নগুলোর স্বীকৃতি জ্ঞাপনে হীনমন্যতা আছে। ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, আরবিভাষীরা বিভিন্ন দেশ ও জাতিকে নিজেদের মতো বলে।আমরা মেক্সিকো, মিশর, ওলন্দাজ, তুরস্ক, পারস্য, ইস্কান্দার নিজেদের মতো বলি বা কারো বলা থেকে নিজেদের করে নিয়েছি, এটা বাংলা ভাষার শক্তি, দুর্বলতা নয়।

আমার ধারনা নেরুদা তার অকালে নিহত বন্ধু লোরকার ভেতরেও রবীন্দ্র প্রীতি ছড়াতে পেরেছিলেন যেহেতু দক্ষিণ  এমেরিকাতে বড় হবার পরও স্প্যানিশের লাতিন শেকড় ধরতে পেরেছিলেন এবং সার্বজনীন স্বরলিপির সূত্রে গীতাঞ্জলীর মূল ধরতে পেরেছিলেন। লোরকার নাটক পড়লে রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য পড়বার আমেজ পাই আমি।

ইয়োরোপের ভাষাগুলো সঙ্গীতে, শিল্পে, আদিবাসী ইতিহাসে, সাম্রাজ্যবাদী লেনদেনে, কল্যানবাদী প্রবর্তনায় বিপুলভাবে ছড়ানো।শুধু সে ভাষাতে লিখতে, পড়তে জেনে এই ভাষাগুলোর ব্যাপকতা ধারণ সম্ভব নয়।অরুন্ধতী রায়, ওলে সোয়িঙ্কার হঠাত থেমে যাওয়ার কারণও এখানে।সোয়িঙ্কা সেটাতে ভারসাম্য এনেছে নিজের ইয়োরুবা সংস্কৃতির শেকড় খুড়ে, অরুন্ধতী সেটা করে ওঠেন নাই।ইল পোস্তিনো সিনেমাতে যেসব তারকারা নেরুদার কবিতা আবৃতি করেছেন, তাদের বেশির ভাগ স্প্যানিশ জানেন না, কিন্তু পারফর্মেন্সের অনুষঙ্গ হিশেবে সঙ্গীতের সার্বজনীন স্টাফ নোটেশান বা স্বরলিপি তারা জানেন।অবশ্যই কবিতা আর গান এক নয়, কিন্তু শব্দের লিরিকাল ভিত্তি জানা খুব দরকারি, যা মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান জানতেন।জীবনানন্দের বনলতা সেন এবং এলেন পোর হেলেন পাশাপাশি পড়বার পরও আমরা জীবনানন্দে বার বার ফিরে আসি।অনুবাদে ভাষা সম্প্রসারিত হয়, তবে কিছু লোকের অনুবাদে ভাষা সঙ্কোচনের সম্ভাবনা থাকে।বলিউডের এত প্রবল প্রতাপ আছে, সেখানে প্রচুর ভাষা থেকে গান নেয়া হচ্ছে, কিন্তু তার পরও হিন্দি বিশ্ব ভাষার মর্যাদা পাচ্ছে না, এমন কি ভারতের অন্য খানেও সাহিত্যে দাগ ফেলতে পারছে না।দেখা যাচ্ছে আধুনিক হিন্দি চর্চা সংস্কৃত শেকড় থেকে সরে গেছে।

ইয়োরোপ, এমেরিকাতে মূল ভাষার পাশাপাশি এখনো স্কুলে ল্যাটিন শেখানো হয়।ল্যাটিনের সূত্র ধরে বাচ্চাদের ভেতর আদিবাসী ভাষাগুলোর সাথে মনোগত সম্পর্ক তৈরি হয়, যা থেকে সাহিত্য, সঙ্গীত, অপেরা, চলচ্চিত্র ধ্রুপদের পাশাপাশি নবায়নে ধারাবাহিকতা হারায় না।মাইকেলের হাতে এ কারণে বাংলা সনেটের যথাযোগ্য সূত্রপাত হয়।মাইকেল লাতিন, সংস্কৃত দুটোই জানতেন।মাইকেলের সনেটগুলোকে ইয়োরোপের প্রাচীন সঙ্গীতের ভাবানুবাদ বলা যেতে পারে।সংস্কৃতের সাথে এবং ইয়োরোপীয় ভাষাগুলোর নবায়িত যাত্রাগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যাবার কারণে, আমাদের সনেটও তেমন বিকশিত হতে পারে নি।চয়ন খায়রুলের রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছের নাম এখানে নেব।প্রায় শ খানেক বছর পর আমরা আবার খোলা সঙ্গীতের ধরনে সনেট পেলাম।আমরা ভালোটুকু বলি না, আড়াল করি।এটা আমার কাছে মিথ্যাচারের মত মনে হয়।

সোআসের প্রবীণ শিক্ষক উইলিয়াম রাদিচের কথাও বলা দরকার।ওনার করা রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ পড়লে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ এবং আজকের কাব্যরস একসাথে পাচ্ছি।এখানে রাদিচে পৌঁছেছেন ম্যাক্সমুলারের পথ ধরে, ম্যাক্সমুলার ভারতীয় আধুনিক ভাষাগুলোর সাথে সম্পর্ক পাতিয়েছেন সংস্কৃত ভাষাকে জেনে।iইংরেজি পুরো ভাষা ও সাহিত্য দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন ল্যাটিন ও ইটালিয়ান অনুবাদের ওপর।বাংলা সাহিত্যে একের পর এক নাট্য-সাহিত্য, গীতিনাট্য মরে যাবার কারণও এখানে লুকায়িত।সংস্কৃত অনুবাদ এখন হয়ে গেছে একাডেমিকের বিষয়।সংস্কৃত ও প্রাক বৈদিক দক্ষিনী ভাষাগুলোর বিবর্তন না ধরতে পারলে আমরা আমাদের ভাষার স্বরলিপি ধরতে পারবো না।আর সে স্বরলিপি ছাড়া অন্য ভাষার অনুবাদ ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ফুটবল খেলার মত।পাস্তেরনাকের জিভাগো পড়েছি ইটালিয়ান থেকে ইংরেজি অনুবাদে।রুশে সেটি অনেক বছর প্রকাশিত হতে পারে নি। পাস্তেরনাক ইংরেজি পড়ে বলেছিল, তার মনে হয়েছে সেটা য্যানো উনি নিজে ইংরেজিতে লিখেছেন।Lost in translation and reclaiming through thranslation ব্যাপারটা বোঝাতে পারলাম কি? আমরা সবাই মিলে এটা চেষ্টা করতে পারি।

আমার নিজের মজা লাগে বোর্হেসের লেখা থেকে যে "Borgesian conundrum/বোর্হেসিয়ান কনান্ড্রাম/বা বোর্হেসিয়ান ধাঁধা নামের দার্শনিক সূত্রটি বেরিয়ে এসেছে তার বিষয়ে।Kafka and His Precursors/ কাফকা এবং তাঁর পূর্বসূরীগনএ বোর্হেস লিখছেন, ''লেখক গল্প লেখে, না কি গল্পটি লেখককে লেখে?'' একজন লেখকের এই ধাঁধার নিষ্পত্তি করতেই জীবন কেটে যায়, আর অনুবাদকের জন্য ধাঁধাটি দুষ্কর হলেও মজার খেলা বৈ কি!বোর্হেসিয়ান ধাঁধার নিস্পত্তিতে আমাদের ভাষার প্রিয় একজন কবির অবস্থান আছে তা জেনেও আমার আনন্দ হয়, বোর্হেস সহ স্প্যানিশ সাহিত্যের ব্যাপকতা জানার আগ্রহ বাড়ে।


নাসরিন-জয়া হক

৫/০৩/২১

বর্দো, ফ্রান্স 


সূত্র : সোআস লাইব্রেরিতে বিভিন্ন  জার্নাল।বোর্হেস, জিমেনেজ, নেরুদা, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, কেতকী কুশারী ডাইসন, উইলিয়াম রাদিচে, চয়ন খায়রুল হাবিবের লেখালেখি।