ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Monday, May 2, 2022

ইদ করলে ঈদের আনন্দ মাটি হবে না!

শামসুজ্জামান খান। মনসুর মুসা। মোহাম্মদ আজম।

আহমেদ শামীম। চয়ন খায়রুল হাবিব।

‘বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে প্রথম বানান হিসাবে 'ঈদ' এবং বিকল্প বানান 'ইদ' দেয়া আছে। প্রথম বানানটি প্রচলিত; ২য় বানানটি সংস্কারকৃত। কোনো মানুষ দীর্ঘকাল কোনো বানান ব্যবহার করলে তা ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে যায়। 'ঈদ' বানানটি তেমনি। অতএব, দুটি বানানই ব্যবহার করা যায়।সমস্যা হলো আরবি ব্যাকরণ আর বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম এক নয়। আরবি ব্যাকরণের নিয়ম এক্ষেত্রে মানলে বহু ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেবে।’

শামসুজ্জামান খান, সাবেক সভাপতি, বাংলা একাডেমি।২০১৭।

চলতি ‘ঈদ’–এর বদলে ‘ইদ’কেই বেশি গ্রহণযোগ্য বলা হয়েছে বাংলা একাডেমির অভিধানে। ঈদ ও নবীর মতো শব্দের বানানে দীর্ঘ ঈ–কার ও হ্রস্ব ই–কারের মধ্যে কোনটি গ্রহণযোগ্য, ইতিহাস না বানানবিধি—কোনটির গুরুত্ব বেশি?

স্মর্তব্য যে পশ্চিম বঙ্গে ও বাংলাদেশে দুটো ভাসা একাডেমি থাকা সত্বেও, বাংলাভাষীরা বিশ্বের সাত নং বড় জনগোষ্ঠী হওয়া স্বত্বেও এ ভাষার সার্বজনীন ডিজিটাল বানান ফন্ট নেই। ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমির অভিধানে ঈ, ঊকার এবং অন্যান্য স্বরবর্ণ সংশ্লিষ্ট বানান সংস্কারের অবকাশ তৈরি  করলেও সার্বজনীন ডিজিটাল ফন্ট না থাকায় এমনকি ওয়াইকিপিডিয়া মুক্তকোষেও একই সন্দর্ভে পর পর দু লাইনে নবি, নবী দেখা গেছে এবং এখনো তাই আছে। বানান সংস্কারের অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, অধ্যাপক মনসুর মুসা, অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম তার পক্ষে বলেছেন। কবি, নাট্যকার চয়ন খায়রুল হাবিব ব্যাবহার বান্ধব জায়গা থেকে তার ব্লগে বেশ আগে থেকে ঈ, ঊ, ণ, চন্দ্রবিন্দু বাদ দিয়ে আসছিলেন, অবশ্য ওনার বইগুলো প্রকাশনার সময় বাংলা একাডেমি প্রচলিত বানান অনুসরণ করে।সেই প্রচলিত বানান অনুসরণের সময় অনেকে সমস্যায় পড়বে। দুটো বিধানের অবকাশ রেখে, বাচ্চাদের ওপর বানানের অজুহাতে মার্কিংও অর্থহীন হয়ে পড়ে, যা এড়াতে অনেকে বানানের ওপর মার্কিং বন্ধ করবার আহবান জানায়।

নিচে আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে এ ব্যাপারে মনসুর মুসা, মোহাম্মদ আজম, আহমেদ শামীম ও চয়ন খায়রুল হাবিবের রচনা তুলে ধরছি।

ঈদ বানানে সমস্যা কোথায়?

মনসুর মুসা


ঈদের ঈ-কে ই করার কোনো মানে হয় না। চিরকালের ঈদের বানান বদলানোর প্রশ্ন তোলার আর সময় পাওয়া গেল না! আর কিছু না পারলে বানান বদলানো হয়। লিখিত ভাষা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব থেকেই এমনটা করা হয় বলে দেখি। ঈদকে দীর্ঘ ‘ঈ’ দিয়ে আবহমানকাল থেকেই লেখা হচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা হয় ‘Eid’। E-এর পর ওই I-টা লেখা হয় দীর্ঘ ‘ঈ’ স্বর বোঝানোর জন্যই। আমি যদি কারও নাম বদলাই, তা ভুল। এতে তার প্রতি অসম্মান প্রকাশ করা হয়। ঈদ তো একটা উৎসবের নাম। নাম ও ট্রেডমার্ক ইচ্ছামতো বদলানো ঠিক নয়। এটা হলো কর্তৃত্বের প্রশ্ন। আজাদ পত্রিকা ৫০ বছর চেষ্টা করেছে ইকবালকে একবাল, ইসলামকে এসলাম লিখতে। টেকেনি। ভাষা বেশি ইডিওসিনক্রেসি বা মতাচ্ছন্নতা পছন্দ করে না।


ভাষার মুখ্য কথ্য ও লিখিত রূপের মধ্যে লিখিত রূপই ভাষাকে স্থায়িত্ব দেয়। লিখিত রূপকে বারবার বদলালে ভাষার শব্দের বিকল্পের মাত্রা বেড়ে যাবে। কিছু কিছু জায়গায় বিকল্প থাকতে পারে, তবে সেটা ভাষা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসতে হবে। হুটহাট বানান বদলালে সময় ও খরচ বেড়ে যাবে; অর্থ বদলে যেতে থাকবে। এতে করে ভাষায় বিশৃঙ্খলাও বাড়ানো হবে। এত বিকল্প থাকা শিশুদের জন্য ভালো নয়। একেক কিছু পড়তে গিয়ে একেক বানান দেখে তারা বিভ্রান্ত হয়। তখন তাদের কাছে ইংরেজিকেই সহজ ভাষা মনে হয়। অথচ বাংলার রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম শৃঙ্খলাবদ্ধ সুন্দর বর্ণমালা। আগে এতে অন্ত্যস্থ ব ও বর্গীয় ব হিসেবে দুটি বর্ণ ছিল। অন্ত্যস্থ ব হলো ইংরেজি ডব্লিউ, বর্গীয় ব হলো বি। আমরা পার্থক্য না বুঝে একটা ফেলে দিয়েছি।


এ সমস্যাটি আমি আমার ‘বানান: বাংলা বর্ণমালা পরিচয় ও প্রতিবর্ণীকরণ’ বইটিতে বিস্তর আলোচনা রেখেছি। বাংলা বানানবিষয়ক আলোচনার গোড়ায় একটি তাত্ত্বিক সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। বাংলা ভাষায় শব্দের জাতবিচার সম্পর্কিত তাত্ত্বিক সমস্যাই বাংলা বানানের নিয়মের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। প্রথাগতভাবে বাংলা শব্দকে পণ্ডিতেরা ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি-এই চার শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। কেউ কেউ আরও একটি বর্গ বৃদ্ধি করেছেন, তার নাম দিয়েছেন অর্ধ-তৎসম। এই বিভাজনের ভেতরে ভাষা-সংগঠনগত সৌসাদৃশ্য কতটা কাজ করে, তা সচরাচর তলিয়ে দেখা হয় না। তদুপরি, অনেক শব্দ আছে, যেগুলোকে প্রথাগত চতুর্বর্গ কিংবা পঞ্চবর্গের আওতায় আনা যায় না। মনে করা যাক: ইংরেজী ভাষায় ইংরেজী শব্দটি নেই, আছে ইংলিশ। শব্দটি তৎসম নয়, তদ্ভবও নয়, বিদেশি তো নয়ই, একেবারে বাংলা। এটা তো বিদেশি নয়, তাহলে এর দীর্ঘ ঈ-কার লোপ করে ই করা কেন?


ঠিক তেমনি ফরাসি শব্দটি কোন ভাষার শব্দ? এটাও তো বাংলা শব্দ। এ ধরনের অনেক শব্দের জাত-বিচারের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। অ-তৎসম বলে কোনো একক বর্গ নেই। ফলে তৎসম ও অ-তৎসম দ্বিভাজন ব্যবহার করে যে বানানের নিয়ম বিধিবদ্ধ করা হয়েছে, তা বিধান হিসেবে সঠিক হয়নি। বাংলা একাডেমির বানানের নিয়মে এই ভ্রান্তি আছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বানানেও এই ভুল আছে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বানানেও আছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানের নিয়মে তো ছিলই।

আরও একটি সমস্যা বানান-সমস্যার সঙ্গে জড়িত, তা হচ্ছে প্রতিবর্ণীকরণের সমস্যা। ব্যাপারটি হচ্ছে বিদেশি শব্দের বানান বাংলা বর্ণ দিয়ে করতে গিয়ে কোন নীতি মানা হবে তা সুনির্ধারিত নয়। প্রতিবর্ণীকরণের সঙ্গে বানান-বিধিকে গুলিয়ে ফেলে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে। ঈদ ও নবী বলব না ইদ ও নবি বলব, সুপ্রীম কোর্ট বলব না সুপ্রিম কোর্ট বলব-এ সমস্যার জন্ম সেখানেই। এসব ক্ষেত্রে ভাষা-ব্যবহার আর বানান সমতাকরণ কিংবা ভাষার বানানের নিয়ম তৈরি করার মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা অনেকেই মানতে চান না।


বিদেশি ভাষার শব্দের বানানে দীর্ঘ ঈ-কার থাকবে না বলা হয়েছে। এই মাপকাঠিটা পরিত্যাজ্য। ১৯ শতক বা ১৮ শতকে ইংরেজরা বিদেশি শব্দ বলতে বোঝাত ফারসি ও ইংরেজিকে। ইংরেজরা বলেছিল সংস্কৃত আলাদা ভাষা। আলাদা বটে, কিন্তু তা তো ইংরেজির মতো বিদেশি না। সে আমলের তিন-চারটি বিদেশি ভাষার জায়গায় এখন তো আমাদের সামনে রয়েছে বিশ্বের অনেক দেশের ভাষা। এখন সংস্কৃত-আরবি-ফারসি-ইংরেজির অনেক শব্দই বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারের নিজস্ব সম্পদ হয়ে গেছে। সুতরাং বাঙালির মুখ দিয়ে যা বের হয়, তা-ই বাংলা বলে মানতে হবে। এর মধ্যে সংস্কৃত নেই, বিদেশি বলেও কিছু নেই। দেশি বা বিদেশি তো রাষ্ট্র দিয়ে ঠিক হয়, রাজনীতি দিয়ে চিহ্নিত হয়। এটা রাজনৈতিক ক্যাটাগরি। বিদেশে গেলে আমাদের পাসপোর্ট নিতে হয়। তাহলে পশ্চিমবঙ্গে যে বাংলা ব্যবহৃত হয়, তাকেও তো বিদেশি বলতে হয়। বিদেশি শব্দ যেকোনো ভাষা থেকে আসতে পারে। না জেনে কোনো ভাষাকে বিদেশি বলে দেওয়া ঠিক নয়। এসব আসলে লিখিত ভাষা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। ভাষার মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চিহ্নগুলো রক্ষা করাই আমার কাজ। দেশে যখন বানান-বাণিজ্য প্রবল হয়েছে, তখন আমি রক্ষণশীল। এটা রক্ষণশীল বনাম ভক্ষণশীলের দ্বন্দ্ব।

মনসুর মুসা: ভাষাবিজ্ঞানী, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক।২০১৭।


‘ঈদ’ নয় ‘ইদ’ই টিকে যাবে
মোহাম্মদ আজম

বাংলা বানানের বর্তমান রীতি ও প্রবণতা অনুযায়ী ‘ঈদ’ না লিখে ‘ইদ’ লেখা উচিত। ‘ঈদ’ লেখা যেতে পারে কেবল প্রচলনের অনুরোধে। কোনো যুক্তিতে নয়। যাঁরা এরূপ যুক্তি তালাশ করেন, তাঁরা সাধারণত মূল উচ্চারণের দীর্ঘস্বরের যুক্তি দেখান। এই ‘যুক্তি’তেই একসময় বানানটি প্রচলিত হয়েছিল। কিন্তু এটি আসলে একটি অপযুক্তি। তার কারণ, বাংলায় কোনো নিয়মিত দীর্ঘস্বর না থাকায় আপনি ‘ঈদ’ বা ‘ইদ’ যা-ই লিখেন না কেন, ‘ইদ’ই উচ্চারণ করবেন। যেমন, আপনি বাঙালী/বাঙালি কিংবা গ্রীক/গ্রিক-যা-ই লিখেন না কেন, আসলে বাংলার নিয়মে হ্রস্বস্বরই উচ্চারণ করেন। কাজেই ‘ঈ’ দিয়ে মূল আরবির স্বর বাংলায় উচ্চারণ করানো সম্ভব নয়। যারা দীর্ঘস্বর উচ্চারণ করেন, তারা মূল শব্দটি জানেন বলেই এ রকম উচ্চারণ করেন, বাংলা বানান দেখে নয়।


কিন্তু বহু দশক ধরে, বিশেষত আমাদের ছাপা হরফের ব্যাপক প্রচলনের সময়জুড়ে, আমরা ‘ঈদ’ই লিখে আসছি। এর একটা ইতিহাস আছে। সেটা মনে করিয়ে দেওয়া সম্ভবত কাজের হবে। উনিশ-বিশ শতকে যাঁরা সংস্কৃতের অনুসরণে বাংলা বানানরীতি নির্ধারণ করেছিলেন, তাঁরা এমন বহু শব্দেও ‘ঈ’ লিখছিলেন, যেগুলো তৎসম শব্দ নয়। ফলে বিশৃঙ্খলা বাড়ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরোক্ষ নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান কমিটি এ ব্যাপারে একটি ফয়সালা করেছিল। সেটা এ রকম : তৎসম শব্দের বানানে সংস্কৃত নিয়ম অনুযায়ী ‘ঈ’ লেখা হবে, কিন্তু অ-তৎসম শব্দের বানানে ‘ঈ’ চলবে না। এ নিয়ম তখন থেকে মোটের ওপর কার্যকর আছে। কিন্তু বিশ শতকের তৃতীয় বা চতুর্থ দশক থেকে ‘মুসলমানপক্ষ’ বলা শুরু করে, যদি সংস্কৃতসম শব্দগুলো ‘মূল’ বানান অনুযায়ী লেখা হতে পারে, তাহলে আরবিসম বা ফারসিসম শব্দগুলো কেন নয়? এ যুক্তিতেই আসলে প্রচুর ‘মুসলমানি’ শব্দে ‘ঈ’, ‘য’ ইত্যাদি লেখা হয়েছিল। কিন্তু আগেই বলেছি, এটি অপযুক্তি মাত্র। কারণ, কোনো ঋণ-করা শব্দই হুবহু ভাষায় আসে না, ঋণী ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব মেনেই গৃহীত হয়। ফলে ‘ঈদ’ সংস্কারপন্থীদের দুর্বল সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় প্রস্তুত অনুকরণমূলক বানানমাত্র।


আজ যে অনেকে ‘ইদ’ বানানে শব্দটি লিখতে চাচ্ছেন, তার কারণ, বাংলা বানানের রীতি ও বিধি ক্রমশ অধিক হারে ‘ই’ এবং ‘ই-কারে’র দিকে চলছে। বাংলা বানানের প্রতিষ্ঠিত বিধিগুলো, যেগুলো দিয়ে আমরা আর দশ বানান লিখে থাকি, সেগুলো ‘ইদ’ বানানের প‌ক্ষেই। কিন্তু বানানের ক্ষেত্রে ‘প্রচলন’ নিয়মের মতোই শক্তিশালী। সে কারণেই যাঁরা দুই বানানের একটিকে ‘ভুল’ বলে সাব্যস্ত করছেন, তাঁরা ঠিক কাজ করছেন না। বলা দরকার, এটি বা ওটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য। লেখার বাজারে দুটিই আরও কিছুদিন একত্রে থাকবে। অভিধানে অবশ্য প্রাধান্য পাবে ‘ইদ’ বানানটি। সঙ্গে দ্বিতীয় ভুক্তি হিসেবে থাকতে পারে ‘ঈদ’। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে লিখতে হবে ‘ইদ’। তা না হলে বানানের প্রচলিত নিয়মের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হবে। দু-এক প্রজন্ম পরেই এ বানান নিয়ে কেউ আর কথা তুলবে না, যেমন ঘটেছে আরও বহু বাংলা বানানের ক্ষেত্রে।

মোহাম্মদ আজম: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।২০১৭।


বিজ্ঞানের ধমকে ভাষা বদলে যায়?
আহমেদ শামীম


বাংলা একাডেমি একটি বানান বিধানের বলে সম্প্রতি ঈদ, নবী ইত্যাদি আরবি ঋণ শব্দের বানান বদলে যথাক্রমে ইদ, নবি করে অভিধানে ভুক্তি দিয়েছে। সঙ্গে, যেমন ইদ ভুক্তিতে, ইদকে বলেছে ‘ঈদ-এর সংগততর ও অপ্রচলিত বানান’। আমরা জানি, বানান তো বানান, ভাষা নিজেই কালে কালে বদলায়। সেসব পরিবর্তন মূলত ভাষাভাষী জনগণ থেকে আসে। কিন্তু যখন প্রতিষ্ঠান ওপর থেকে কোনো অপ্রচলিত বানান প্রবর্তন করতে চায়, তখন এসব অপ্রচলিত বানান প্রবর্তনের তাগিদ কোথা থেকে এল, আবার সেই অর্বাচীন বানান প্রাচীনটির চেয়ে কিসের দিক থেকে ‘সংগততর’-এমন সব প্রশ্ন না উঠে পারে না।

বাংলা একাডেমি বিধান দেয়, কোনো সংস্কৃত শব্দের বানানে যদি দীর্ঘ ঈ এবং এর কার চিহ্নের ব্যবহার থাকে, সেই শব্দ যদি বাংলায় প্রবেশ করে, তাহলে তার বাংলা বানানেই কেবল দীর্ঘ ঈ এবং এর কার চিহ্নের ব্যবহার আবশ্যক। সংস্কৃত ভিন্ন অন্য কোনো ভাষার শব্দের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এই বিধান অনুযায়ী প্রচলিত ঈদ ও নবী বানান হয় ইদ ও নবি। যদিও এই আরবি শব্দগুলোর উৎসে দেখা যায়, আলোচ্য স্বরটি দীর্ঘ, তবু যেহেতু উপরিউক্ত বিধানটি সংস্কৃতের জন্য সংরক্ষিত, তাই এদের ভাগ্যে বরাদ্দ হলো ই ও ই-কার।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, বিধানটির দরকারই বা পড়ল কেন, আর তা সংস্কৃতের জন্যই কেবল সংরক্ষিত কেন? প্রশ্নদ্বয়ের একটা উত্তর হলো সংক্ষেপে, বাংলা সংস্কৃতের কন্যা তাই। অনেক বিশেষজ্ঞ আবার মত দিয়েছেন, না, বাংলা সংস্কৃতের কন্যা নয়, তবে একই আত্মীয় বটে। কন্যা হোক আর আত্মীয় হোক-এখানে বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতের সম্পর্কের দাবিটির জোরেই কিন্তু বিধানটি বলবৎ হয়। সেখানেও প্রশ্ন থাকে। সংস্কৃতে ই এবং ঈ ধ্বনিগত পার্থক্য আছে, সেই পার্থক্যের কারণে অর্থেরও পার্থক্য হয়-যেমন ইষ মানে খোঁজা, ঈষ একটা মাসের নাম; কিন্তু তেমন ঘটনা বাংলায় ঘটে না, কেননা বাংলায় দুটি নয় বরং একটিমাত্র উচ্চ সম্মুখ স্বরধ্বনি আছে। তাহলে বাংলা বর্ণমালায় ই এবং ঈ বর্ণ তার নিজ নিজ কার-চিহ্নসহ রাখা হলো কেন? এ প্রশ্নের জবাব জানতে আমাদের আলোচনা করতে হবে বাংলা লিপির সঙ্গে বাংলা ভাষার সংযোগের ইতিহাস এবং পর্যালোচনা করতে হবে সেই ইতিহাসের নায়কদের কীর্তিকর্ম।

বাংলা বর্ণমালায় আমরা এমন কিছু বর্ণ দেখি, যার জন্য কোনো ধ্বনি বাংলায় নেই-তার মানে এই বর্ণমালাটি বাংলা ভাষার জন্য যখন ব্যবহার শুরু করা হয়, তখন ভাষার ধ্বনিভান্ডারের সঙ্গে সংগতি রেখে অভিযোজন করা হয়নি। এই অসংগতির কারণ দেবনাগরী লিপিতে লিখিত সংস্কৃত ভাষার প্রতি সেই ইতিহাসের নায়কদের প্রেম। এ কথা অস্বীকার করার জো নেই, দেবনাগরী এবং বাংলালিপি একই উৎস ব্রাহ্মী লিপি থেকে আগত। কিন্তু দেবনাগরী যেমন সংস্কৃতের জন্য অভিযোজিত, বাংলালিপি বাংলা ভাষার জন্য তেমন অভিযোজিত নয়। এটা বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তির বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ। সেই অসংগতি সামাল দেওয়ার জন্য পরে ণত্ব বিধান ষত্ব বিধান বাংলাতেও চলে এসেছিল-এখন যেমন দীর্ঘ-ত্ব বিধান এল। এসব বিধান আলগা, আরোপিত, বাংলা ভাষার স্বভাব বিধি নয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই আরোপ ইতিহাসের মর্যাদায় আসীন হয়ে আছে।

একটি বিদ্যমান বর্ণমালাকে নিজের বলে দাবি করার ক্ষেত্রে উপরিউক্ত অভিযোজন তথা সংযোজন-বিয়োজন কর্মটি গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তখন সেই নায়কদের কাছে অগুরুত্বপূর্ণ ঠেকেছিল, কেননা দৃশ্যত তারা সংস্কৃত ও বাংলার সাংস্কৃতিক সংযোগকে ঐতিহাসিক সংযোগ হিসেবে পরিচয় দিতে অধিক উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু বাংলা যে আর্য-প্রাকৃত-অনার্য-ম্লেচ্ছ ইত্যাদি সংস্কৃতি ও তাদের বাগ্‌ধারার মেলবন্ধনে বিকশিত হলো, সেই সংস্কৃতি ইতিহাসে উন্নীত হলো না ওই সব সংস্কৃতপ্রেমী সংস্কৃত-পণ্ডিত ইতিহাসের নায়কদের সযত্নে। আর সে কারণে এতকাল ঈদ, নবী বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হওয়ার পরও তা বাংলা ভাষার লিখিত বর্ণনের ইতিহাস হয় না-সংস্কারযোগ্য সংস্কৃতি আকারেই থেকে যায়। বিজ্ঞানের ধমক দিয়ে তাদের বদলে দেওয়া যায়? ইতিহাসের যুক্তি দেখিয়ে পাল্টা দাবি করতে গেলে সেই দাবিকে নিছক ‘সাংস্কৃতিক রাজনীতি’ নাম দিয়ে খাটো করা যায়! যে বিজ্ঞানে সংস্কৃত ঋণ ঐতিহাসিকতার দোহাইয়ে অবিকল থাকে, সে বিজ্ঞান ব্যবহার করে ঐতিহাসিকভাবে জনপ্রিয় বানান বদলে দেওয়া আর যাই হোক ন্যায্যতার উদাহরণ নয়।

যেমন উচ্চ সংস্কৃতির গান হয় সংগীত আর নিম্ন সংস্কৃতির গান হয় লোকসংগীত; সেখানে লোক শব্দটি প্রধান ধারার সংগীত থেকে তাকে আলাদা করা হয়-তেমন উচ্চ সংস্কৃতি ইতিহাস হবে এটাই দস্তুর, নিম্ন সংস্কৃতির রাজনীতি হবে ‘সাংস্কৃতিক রাজনীতি’! অথচ এটা লুকানো সম্ভব নয় যে এই উচ্চ সংস্কৃতি এবং নিম্ন সংস্কৃতি বিভেদায়নে আর্থরাজনৈতিক কলগুলো সর্বক্ষণই চলমান। ঈদের বানান বদলের বেলাতেও সেই কলের কাজই দেখা গেল।

আহমেদ শামীম: শিক্ষক, বাংলা ভাষা, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র।২০১৭।


পোকায় কাটা কয়েকটা দাত ফেলে দিলেই দুখিনি বর্নমালার দাত ব্যাথা সেরে যাবে

চয়ন খায়রুল হাবিব

*সম্প্রতি অভ্র ইউনিকোড ফন্টের ডেভলাপার এবং চর্চাকারিদের  সাথে,  বিজয়-পন্য-সামগ্রির যে বিরোধ তাতে সঙ্গত কারনেই আমার অভ্র দলের দিকে পক্ষ্যপাত করা দরকার।আমি অভ্র ব্যবহার করি। আনফ্রেন্ডলি সফটওয়্যার হওয়াতে বিজয়, সোলায়মানি এসব কখনোই ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনি।

সখ্যতার সহজিয়ায় অভ্র ইউনিকোড, বিজয়-পন্য-সামগ্রি থেকে অনেক এগিয়ে থাকলেও; ভাষার পেছনে ভাব প্রকাশ'কে অর্গলমুক্ত করবার এবং আবার ভাষাকেই শ্রেনি শাষনের মুল হাতিয়ারে পরিনত করবার যে-কায়েমি প্রয়াস  সেই দার্শনিক বিরোধে; অভ্র এবং বিজয়ের দ্বন্দকে আমার শুধু skill বা প্রায়োগিক মনে হয়েছে; মনে হয়েছে সামগ্রিকভাবে  যে-জিঞ্জিরা কালচার চলছে তারই বিস্তার; এর পেছনে সনাতনের অচলায়তন ভাংবার কোন ইশারা এখনো পাই নি!

আমি লম্বা ঈকার, লম্বা ঊকার, চাদবিন্দু ব্যাবহার করতে চাই না।অভ্রে 'দাঁড়িয়ে' লিখতে গিয়ে, আমি নিজের ভঙ্গিতে দাড়িয়ে পড়ি এখনো;  জীবন লিখতে গিয়ে কবিতা-বাসরে শুরু করি নিজের ভঙ্গিতে জিবনযাপন! কেন জানি মনে হতে থাকে অভ্রের চিন্তাপধ্বতি প্রাতিষ্ঠানিক নিক্তি পাল্লার সেদিকেই ঝুকে পড়া যেদিকে বাংলাভাষাভাষি সমাজ ক্রমশই তলিয়ে যাচ্ছে আরো আরো সংস্কারের জগদ্দল আড়ালে!

ইংরেজি ভাষাতে যেরকম বিট প্রজন্মের গ্রেগরি কর্সো; আজকের বেঞ্জামিন জেফনায়ার মত  কবিরা প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য চর্চার বাইরে নিজেদের লালনের পরেও মুলধারাতে আদৃত হয়েছেন মেজর কবি হিশেবে পোয়েটিক লাইসেন্সের গুনে; সেই কাব্যিক সুষমার পত্তনি আমি বাংলা সফটয়্যার ডেভলপারদের মধ্যে দেখি না।বাংলাভাষা ঘিরে যে-প্রানের মেলা, সেখানে ফন্টের পর ফন্ট এলেও স্পেল চেকারের অভাবে প্রুফ রিডারে্রা হয়ে গেছে সে-প্রানস্পন্দনের সম্পাদক, প্রকাশক, ব্যাবস্থাপক!এই প্রুফ রিডার শ্রেনির ছড়ি ঘোরানোকেই আমরা মোটাদাগে মেনে নিচ্ছি পাষবিকতা ও পেলবতার সিমা-সরহদ্দ বলে!

কবিতার অন্তস্থ ভাবনাকে যে নির্মেদ, নিরলঙ্কার, সংস্কারবিহিনতার জায়গা থেকে দেখি; স্পেলচেকারের শুন্যতার সুজোগে উড়ে এসে জুড়ে বসা  অর্থনিতিবিদ থেকে অভিধান রচনাকারি বনে যাওয়া কলিম খানের অতি উতসাহি অনুসারিরা যখন আমার সেই coreকে আক্রমনের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলে; তখন বুঝি যে  লম্বা ঈকার, লম্বা ঊকার, চাদ বিন্দুর বিরুধ্বে আমার সংগ্রাম'টা অযথার্থ নয়।৮ বছর বয়সিদের গড়পরতা মেধার সমান মেধাবি একটা স্পেলচেকারই হাজারো কলিমের মামদোবাজি বন্ধের জন্য যথেস্ট।বাই ডিফল্ট খান সেনানিদের ছড়ি ঘোরানো,   আমার বানান ভাবনাকে একেবারেই বিড়ম্বিত করে নাঃ

কারন, আমার স্বরবর্ন ৮টা!ব্যাঞ্জনবর্নও একই অনুপাতে কম!

আমার লেখ্য বাংলা'কে আমি বলি লজবাং বা লজিকাল বাংলা!তবে দন্ত, মুর্ধা, তালব্যের উচ্চারনে আমি আপনাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম! চ্যালেঞ্জ করলাম প, ফ এর উচ্চারন নিয়েও! শোনা যাক কে কত নাকামি করতে পারে! আমি নাকামি পারিনা।নাকামি লিখিও না!চ্যালেঞ্জ নেবার আগে একটু ভাববেন! গোলাম মুর্শিদও এখনো shepherdকে শেপহার্ড না লিখে, লিখছেন শেফার্ড!একজন স্টেশান'কে বানিয়ে ফেলেছেন 'স্টেশণ', আর ডিক্রি জারি করছেন যে বিদেশি সব শব্দের বানানে 'ন' এর বদলে 'ণ' বসাতে হবে!নাক বা নরুন যে বিদেশি শব্দ না, তা আমরা নিশ্চিত হবো কিভাবে! একাডেমি না আকাদমি?ফৃ না ফ্রি?ওপরচালাকি না কি উপরচালাকি?

সবাই খেয়ে বাচুক!বাজে ঢেকুরের গন্ধ ভালো পান, জর্দাতে ঢাকা দিলেও তাতে পেটের ব্যামো সারে কি?বানান নিয়ে নানা পরামর্শগুলোর যেটুকু বুঝেছি, নন্দনের বিচ্চারে তা আমার কাছে গ্রহনযোগ্যও মনে হয়নি, দরকারিও বোধ হয় নি!তবে মনে হয় এ-নিয়ে অনেকের বানান-বিশ্বাস-কেন্দ্রিক-ধর্মবোধ আছে!থাকতেই পারে।তবে একই ধর্মের ভেতর য্যামন ভিন্ন ধরনের চর্চা থাকতে পারে, বাংলা ব্যাবহারকারিদের পখ্যে সেরকম কি বাংলার চর্চাতেও বিচিত্রতা মেনে নেয়া সম্ভব?

কে এক বরেন্য রাস্ট্রনেতা বলেছিলঃ In victory magnanimity:

চাকমা, গারো, সাওতাল, বিহারিদের কি বাংলাভাষাভাষি আমলাতন্রের ভাগিদার হতে বাংগালির চেয়েও ভালো বাংলা শিখতে হবে?৫২'র ভাষা আন্দোলনের একটা দিক য্যামন মাতৃভাষার স্বিকৃতি, তেমনি রাস্ট্রের চাপানো সিধ্বান্তের বিরোধিতা।ভাষা আন্দোলনের আধা শতাব্দি পর বিদেশি শব্দ খুজে বের করা, অনলাইনে 'বানান পাঠশালা' খোলা জয়ের গৌরবের বদলে, জয়-মদমত্ত- হিনমন্যতার পরিচায়ক।

যেখানে, বাংলাভাষি জনগোষ্ঠির চেয়ে অনেক, অনেক কম সংখ্যার এবং একটাও নোবেল পুরস্কার না পাওয়া ভাষাগুলোর প্রচুর 'স্পেলচেকার' সফটওয়্যার আছে, সেখানে দু, দুটো একাডেমি থাকা স্বত্ত্বেও কোনরকম ডাউনলোডেবল স্পেলচেকার না থাকা ঘড়ির কাটাকে ভামিয়ান ধ্বংশের জিরো আওয়ারে ফেরানোর সামিল।দ্রস্টব্য যে ব্রিটেনে বাচ্চাদের এখন আর বানানের ওপর মার্কিং করা হয়না।যা স্পেলচেকা্রের বাইনারি সিস্টেম করে দিচ্ছে, তা নিয়ে বাচ্চাদের প্রাথমিক মেধার অপচয় করতেও ব্রিটেন রাজি নয়।

প্রাইভেট শিক্ষকের কাধে ভর দিয়ে , ভালো 'বানান' শিখে-পড়ে, উচ্চবিত্তের বা মধ্যবিত্তের ছানাপোনারা যেভাবে ধেই ধেই করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল এবং তার ফলস্রুতিতে খমতাকাঠামোতে ওপরের সিড়িতে চলে যেতে পারে, শ্রমজিবি সাধারনের পখ্যে তা সম্ভব নয়।উচ্চারন ও বানান-বিকারের সিমা-সরহদ্দ ঘটিয়ে খমতাকাঠামোতে; বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঙ্গিতিনিকেতনে, চারুকলা ভবনে নন্দন উপভোগের অধিকারে যে শিব্যলেথ ঘটানো হচ্ছে তাও ৫২'র উত্তরাধিকার নয়।

ভাষাকে কায়েমি স্বার্থে ব্যাবহারের প্রবনতাই য্যামন একদিকে সাধারনের সাথে এনার্কিস্ট লেখক সাবদার সিদ্দিকি, মুস্তফা আনোয়ারদের পরিচয় করিয়ে দেয় না; সেই একই প্রবনতা থেকেই আবার ফানডামেন্টালিস্ট শিবিরগুলো এই এনার্কিস্ট লেখকদের হাইজ্যাক করে, যাতে করে মনমতো অপব্যাখ্যা করা যায়!একই কারনে ডগমাটিক রাস্ট্রকাঠামোগুলো এবং মৌলবাদি প্রতিষ্ঠানগুলো লোক সংস্কৃতির ব্যাপারেও হয়ে ওঠে অতি উতসাহি।সোভিয়েতের ইতিহাস দেখা যাক; পাস্তেরনাক'কে বলছে বুরজোয়া, সোলঝেনিতসিন'কে পাঠাচ্ছে গুলাগে, প্রচার করছে রুপকথা, উপকথা!কিন্তু এসব যে শুভংকরের ফাকি তা কিন্ত সোভিয়েতের শাষনাধিন প্রজাতন্ত্রগুলো বুঝে ফেলেছিল।ঐ প্রজাতন্ত্রগুলো চাপানো রুশ ভাষাও কখনো মেনে নেয় নাই।

বাংলা ভাষাতে মুখের বুলি আর লেখার রুপ, বিরুপের সমকালিন বিবর্তনগুলো দেখা যাক! ব্র্যাকেটের পোকায় কাটা লম্বা ঈকার, লম্বা ঊকার, ণ' এর বিকার না থাকলেও নিচে লেখা সত্যগুলোর হেরফের হত'নাঃ

ক. বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষ(ণ)… আঞ্চলিক, কথ্য, শুদ্ধ, অশুদ্ধ তর্কের উর্ধ্বে মিথে পরি(ণ)ত হয়।

খ. র(বী))ন্দ্রনাথ কি কোলকাতার ভাষায় লিখতেন? সন্দেহা(তী)ভাবে না। অন্যান্য কোলকাতাবাসির মত ঠাকুরবাড়ির লোকদেরও দন্ত্য স, তালব্য শ, মূর্ধন্য ষ উচ্চার(ণে) সমস্যা ছিল। কবিগুরুকেও নিজের সাহিত্য ভাষাকে কথ্যভাষার অকথ্য উচ্চারন(ণ) রিতি থেকে সরিয়ে অন্য আরেকটি মান তৈরি করতে হয়েছিল। মাইকেলও কোলকাতার ভাষায় না লিখে মিশনারি বাংলায় মহাকাব্য লিখতে ব্র(তী) হন। তবে র(বী)ন্দ্রভাষাই মানভাষা হিশেবে চালু হয়ে যায়।

গ. মুজতবা আ(লী) সিলেটের ভাষায় বা (জী)বনানন্দ বরিশালের ভাষায় লিখলে ওদের সাহিত্যের (কী)
পরি(ণ)তি হতো বলা মুশকিল।

ঘ. ২০০৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এক বন্ধুর বাসায় ঢাকা ও কোলকাতার কজন কবির সাথে পরিচয় হয়েছিল। বেশ ফাটাফাটি হাসাহাসির ভেতর কোলকাতার কবিদের নিজেদের কবিতার স, শ, ষ-গুলো উচ্চার(ণ) করতে বললে তিনজনই ফেল মারলেন।

ঙ. গোলাম মুরশিদ আক্ষেপ করছেন যে কোলকাতা কেন্দ্রিক স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ও ঢাকা কেন্দ্রিক স্ট্যান্ডার্ড বাংলার দূরত্ব তৈরি হলে আমরা ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হব। যে কেন্দ্রিকতা কখনো তৈরি হয়নি তাকে নিয়ে নস্টালজিয়া অর্থ(হী)ন। আরেকটি নতুন কেন্দ্রিকতা হবে ওয়েব-কেন্দ্রিকতা।

চ. কিশোরগঞ্জ থেকে আসা (নী)রদ চৌধু(রী) থেকে আজকের ঢাকায় বসবাসরত কিশোরগঞ্জি সাহিত্যের যে বিবর্তন হয়েছে তা নিয়ে মজার লেখা হতে পারে।

শেষমেষ,আমাদের আগে বহু ভাষাই শুদ্ধতার যোয়ালে ধ্বংশ হয়েছে!শাষকের প্রবল সমর্থনেও সংস্কৃত, ল্যাটিন বা উর্দু টিকে নাই!ধন্যবাদ।

চয়ন খায়রুল হাবিব, কবি ও নাট্যকার।ব্রিটানি, ফ্রান্স।২০১০।


সম্পাদনা : নাসরিন-জয়া হক